আসামিদের নিয়ে ওসির ‘আনন্দ উদ্‌যাপন’, মামলার বাদীর শঙ্কা

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ওসি মোস্তাফিজ মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তাঁর বাঁ পাশে ফয়েজ ও মামুন এবং ডান পাশে হাসান, কবির, আলাউদ্দিনসহ আরও কয়েকজন ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। গতকাল রোববার বাউফল থানা-পুলিশের আনন্দ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

দ্রুত বিচার আইনের মামলার আসামিদের নিয়ে পটুয়াখালীর বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমানের আনন্দ উদযাপনের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ওসির গুণকীর্তন করে আসামিদের স্ট্যাটাস ও সেলফিও ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার বাদীর শঙ্কা, মামলার সঠিক তদন্ত হবে না।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করায় গতকাল রোববার বিকেলে বাউফল থানা-পুলিশ ‘আনন্দ উদযাপন’ নামের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সেখানে একটি দ্রুত বিচার আইনের ধারার চার আসামিসহ মাদক ও ছিনতাই মামলার আসামিরা যোগদান করেন। এই আসামিরা কেউ জামিনে নেই।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, পূর্ববিরোধ ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মো. ফয়েজ বিশ্বাসের (২৫) নেতৃত্বে ১৮-১৯ জনের একটি দল বটকাজল গ্রামের ব্যবসায়ী মো. মিজান মৃধার বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। ওই সময় হামলাকারীদের ভয়ে মিজানের বড় ভাই শাহিন আলম (৪০) অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই ঘটনায় পটুয়াখালীর আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আদালতে ১৮ ফেব্রুয়ারি মিজান বাদী হয়ে নাম উল্লেখ করে আরও পাঁচ-সাতজন অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে নালিশি অভিযোগ করেন। আদালত অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে বাউফল থানার ওসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। বাউফল থানার ওসি ২৫ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন। মামলা নম্বর ২৯।

রোববার বিকেলে বাউফল থানা-পুলিশ ‘আনন্দ উদযাপন’ নামের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সেখানে একটি দ্রুত বিচার আইনের ধারার চার আসামিসহ মাদক ও ছিনতাই মামলার আসামিরা যোগদান করেন।
ছবিতে আসামিদের সঙ্গে ওসি
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

রোববারের আনন্দ উদযাপনের ওই অনুষ্ঠানে দ্রুত বিচার আইনের মামলার তালিকার ১ নম্বর আসামি মো. ফয়েজ বিশ্বাস (২৫), ২ নম্বর আসামি মো. মামুন হাওলাদার (৩২), ৩ নম্বর আসামি মো. কবির মৃধা (৩০), ৯ নম্বর আসামি মো. হাসান দফাদার (৩০), ১০ নম্বর আসামি আলাউদ্দিন খানসহ (৩০) তাঁদের সমর্থিত অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আসামি কবির দুবার বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একাধিক মামলা রয়েছে। হাসান ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন।

ফেসবুকে গতকাল সন্ধ্যায় পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, ওসি মোস্তাফিজ মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তাঁর বাঁ পাশে ফয়েজ ও মামুন এবং ডান পাশে হাসান, কবির, আলাউদ্দিনসহ আরও কয়েকজন ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। ফয়েজ বিশ্বাসের আইডি থেকে পোস্ট করা সেলফিতে দেখা যায়, ওসি মোস্তাফিজ ও ফয়েজ হাস্যোজ্জ্বল। তিনি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘একজন সৎ পুলিশ অফিসার, স্যার আপনার হাতেই নিরাপদ আমাদের বাউফল। স্যারের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।’

প্রধান আসামি ফয়েজ বিশ্বাস ফেসবুকে ওসির সঙ্গে তাঁর সেলফি দিয়ে লিখেছেন, ‘একজন সৎ পুলিশ অফিসার, স্যার আপনার হাতেই নিরাপদ আমাদের বাউফল। স্যারের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।’

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ওই অনুষ্ঠানের শুরুতে থানা চত্বরের ফুল বাগানের পাশে ও অনুষ্ঠান চলাকালে তাঁরা ওসি মোস্তাফিজুরের সঙ্গে ছবি ও সেলফি তোলেন। আসামিরা ওই ছবি ও সেলফি তাঁদের ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, ‘ওরা যে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, তা সবাই জানে। তাদের সঙ্গে ওসির হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি।’ তাঁরা ওসির প্রত্যাহার দাবিসহ বিচার দাবি করেন।

ফয়েজ বিশ্বাসের আইডি থেকে পোস্ট করা সেলফিতে হাস্যোজ্জ্বল ওসি মোস্তাফিজ ও ফয়েজ বিশ্বাস
ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

এ বিষয়ে মামলার বাদী মিজান মৃধা আজ সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও আসামিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। এমনিতেই আসামিদের হুমকির কারণে তিনি ও তাঁর পরিবারের সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। ওসির সঙ্গে আসামিদের সখ্যের ছবি দেখে তিনি হতভম্ব ও মামলার সঠিক তদন্ত নিয়ে শঙ্কিত।
বাদীপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ মোহাম্মদ মোহসিন বলেন, মামলা তদন্তকালীন আসামিদের নিয়ে আনন্দ উদযাপন, তাও আবার দ্রুত বিচার আইনের ধারার মামলায়। এটা খুবই দুঃখজনক, যা সঠিক বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আনন্দ উদযাপন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। অনেকেই আমার সঙ্গে ছবি ও সেলফি তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে কে আসামি, আর কে আসামি না, তা আমি চিনতে পারিনি।’