ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়ানোয় নাকাল লঞ্চযাত্রী

ঢাকা–বরিশাল নৌপথের যাত্রীবাহী লঞ্চ। বরিশাল লঞ্চঘাটে
ফাইল ছবি

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বরিশাল-ঢাকা ও দক্ষিণের নৌপথে চলাচলকারী বড় লঞ্চগুলোতে জ্বালানি ব্যয় আগের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু নৌযানগুলোতে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৪০ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত। আর বর্ধিত ভাড়ার এই গ্যাঁড়াকলে সবচেয়ে বেশি ভাড়া গুনতে হবে ডেকে চলাচলকারী নিম্ন আয়ের যাত্রীদের।

৩ নভেম্বর রাতে ডিজেলের দাম একলাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা লিটার করেছে সরকার। ফলে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে গত শুক্রবার ভোর থেকে সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ রাখেন মালিকেরা। এরপর তিন দিন ধরে পথে পথে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। এর সঙ্গে লঞ্চ ধর্মঘট যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়।

সংকট নিরসনে রোববার দুপুরে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বনানী কার্যালয়ে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির বৈঠক হয়। বাসমালিকদের পাঁচ ঘণ্টার এ বৈঠক শেষে বর্ধিত ভাড়া ঘোষণা করা হয় ২৭ শতাংশ। আর যাত্রীবাহী নৌযানে বৃদ্ধি করা হয় ৩৬ শতাংশ। সোমবার থেকেই এই বর্ধিত ভাড়া কার্যকর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু লঞ্চমালিকেরা সরকার নির্ধারিত ৩৬ শতাংশ ভাড়ার বদলে সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধি করেছে।

বর্ধিত ভাড়ার এ চাপে বেহাল সাধারণ মানুষ। ভাড়া বাড়ানোয় বাস কাউন্টারে, নদীবন্দরে এসে যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। দুদিন ধরে এ ক্ষোভের কথা শোনা যায় সাধারণ যাত্রীদের মুখে।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, জ্বালানিমন্ত্রী সেদিন জ্বালানির দাম বাড়ার পেছনে ভারতে পাচার রোধ ও বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু এ যুক্তির পেছনে নৈতিক ভিত্তি নেই। এতে সক্ষমতার ঘাটতির প্রমাণ হয়। যদি তা–ই হয়, তবে তা জনগণের মাথায় চাপানো হচ্ছে কোন যুক্তিতে? সরকার ব্যবসায়ীদের কাছে নতজানু বলেই এমন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ঢাকা-বরিশাল নৌপথে তাঁদের লঞ্চটি আসা-যাওয়া (আপ-ডাউন) করতে ৭ হাজার ৮০০ লিটার ডিজেল লাগে। আগের মূল্য অনুযায়ী এ পরিমাণ ডিজেলের ব্যয় হতো ৫ লাখ ৭ হাজার টাকা। বর্ধিত মূল্যে এ পরিমাণ ডিজেল কিনতে খরচ হচ্ছে ৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। ফলে আগের চেয়ে জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা।

ঢাকা-বরিশাল পথে চলাচলকারী এমভি সুন্দরবন-১০ লঞ্চটির কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-বরিশাল নৌপথে তাঁদের লঞ্চটি আসা-যাওয়া (আপ-ডাউন) করতে ৭ হাজার ৮০০ লিটার ডিজেল লাগে। আগের মূল্য অনুযায়ী এ পরিমাণ ডিজেলের ব্যয় হতো ৫ লাখ ৭ হাজার টাকা। বর্ধিত মূল্যে এ পরিমাণ ডিজেল কিনতে খরচ হচ্ছে ৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। ফলে আগের চেয়ে জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। তাতে জ্বালানি ব্যয় বাবদ লঞ্চটির ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮ শতাংশ। অপর দিকে আগে এ লঞ্চে ডেকের ভাড়া ছিল জনপ্রতি ২৫০ টাকা। এখন তা ৩৫০ টাকা। এতে ডেকের ভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশ। আর সিঙ্গেল কেবিন আগের ১ হাজার টাকার স্থলে এখন তা ১ হাজার ৪০০ টাকা। ফলে কেবিনে ভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশ। আর ডাবল কেবিন আগের ২ হাজার টাকার স্থলে এখন ২ হাজার ৪০০ টাকা করা হয়েছে। তাতে ডাবল কেবিনে ভাড়া বেড়েছে ২০ শতাংশ। আর ভিআইপি কেবিনে ভাড়া বেড়েছে ৩৩ শতাংশ।

সুন্দরবন-১০ লঞ্চের পরিদর্শক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘গরমের সময় পানির চাপ বেশি থাকায় আমাদের জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যায়। সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ীই আমরা সমন্বয় করে ভাড়া পুননির্ধারণ করেছি।’

একইভাবে বরগুনা-ঢাকা পথে চলাচলকারী এম ভি ফারহান-২ ও পূবালী-১ নামের লঞ্চ দুটিতে যাওয়া-আসায় জ্বালানি ব্যয় হয় যথাক্রমে ৫ হাজার ৫০০ ও ৬ হাজার লিটার। এ দুটি লঞ্চেও জ্বালানি ব্যয় ১৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। কিন্তু এ পথে ডেকের যাত্রীদের ভাড়া ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৮৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ডেকের যাত্রীদের বাড়া বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। আর সিঙ্গেল কবিনের ভাড়া ১ হাজার ২০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ করা হয়েছে। এতে ভাড়া বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। আর ডাবল কেবিনের ভাড়া ২ হাজার ৪০০ থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত করা হয়েছে। এতে ভাড়া বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

আমরা যতদূর জানি, কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তাতে ৩৬ শতাংশ হারে যা আসে, সেভাবেই নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপরও যদি বাড়তি নেওয়া হয়, তবে সেটা আমরা খতিয়ে দেখব।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান, যুগ্ম পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন), বিআইডব্লিউটিএ, বরিশাল অঞ্চল

ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে পূবালী লঞ্চটির ব্যবস্থাপক এনায়েত হোসেন বলেন, ‘আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ভাড়া বাড়িয়েছি। সব ব্যয় ও দূরত্ব সমন্বয় করেই এটা নির্ধারণ করা হয়েছে।’

বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মো. মোস্তাফিজুর রহমান মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যতদূর জানি, কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া বৃদ্ধি হয়েছে। তাতে ৩৬ শতাংশ হারে যা আসে, সেভাবেই নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপরও যদি বাড়তি নেওয়া হয়, তবে সেটা আমরা খতিয়ে দেখব।’