ইতিহাসের আলপথে অবাধ বিচরণ

চট্টগ্রাম সম্পর্কে ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচন করেছিলেন আবদুল হক চৌধুরী। চট্টগ্রামের ইতিহাসের আলপথে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ।

আবদুল হক চৌধুরী

সুপ্রাচীনকালে চট্টগ্রামের ভূখণ্ডের অস্তিত্ব ছিল না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় অথবা পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্‌বেদেও চট্টগ্রাম সম্বন্ধে উল্লেখ দেখা যায় না। পরবর্তীকালের শুক্ল যজুর্বেদে উল্লেখ আছে যে গণ্ডকী নদীর পূর্ব দিকটা জলমগ্ন ছিল। তখন হয়তো চট্টগ্রামের উচ্চতম পর্বতমালার শীর্ষদেশগুলো সবেমাত্র নীল সাগরের অথই পানির ওপর দেখা যেতে শুরু করেছিল।’ অতীতের অথই অন্ধকারে ভেতর চট্টগ্রামের অস্তিত্ব খুঁজে বের করে কৃতি গবেষক আবদুল হক চৌধুরী পণ্ডিতদের এই ধারণা ভুল বলে প্রমাণ করেছেন। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম একটি সুপ্রাচীন দেশ। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তাঁর গবেষণাগ্রন্থ চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখায় তিনি লিখেছেন, ‘১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড পর্বতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে পণ্ডিতগণের চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে অভিমত মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়। চট্টগ্রাম একটি সুপ্রাচীন দেশ বলে প্রমাণিত হয়। সে সময় সীতাকুণ্ড পর্বতে বাংলাদেশের সুপ্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন নব্য প্রস্তর যুগের অশ্মীভূত কাষ্ঠের তৈরি হাতিয়ার, কৃপাণ আবিষ্কৃত হয়। ফলে এ কথা বলা চলে যে চট্টগ্রাম একটি প্রাচীন ভূখণ্ড।’

শুধু এ তথ্য নয়, চট্টগ্রাম সম্পর্কে ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচন করেছিলেন আবদুল হক চৌধুরী। চট্টগ্রামের ইতিহাসের আলপথে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। তাঁর গ্রন্থগুলো সামনে নিয়ে বসলে চট্টগ্রামের অতীত চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে হয়, অক্ষরে অক্ষরে ইতিহাসের পথে প্রান্তরে হেঁটে চলছে এক গবেষক। চট্টলতত্ত্ববিদ হিসেবে খ্যাত আবদুল হক চৌধুরী চিরস্মরণীয় তাঁর গবেষণার জন্য। শুধু চট্টগ্রাম ভূখণ্ডের জন্ম-ইতিহাসের অনুসন্ধান তিনি করেননি, একই সঙ্গে এ অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতি, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনাচার, ভাষা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। অনেকটা নিজ গরজেই তিনি এসব তথ্য অনুসন্ধান করে হয়েছেন ইতিহাসের বরপুত্র। অথচ নবম শ্রেণি পাস করেছিলেন তিনি। এরপর আর পড়াশোনা এগোয়নি। তবে তাঁর তথ্যানুসন্ধানের গভীরতা ছাড়িয়ে গেছে অন্য অনেককেই। এ সবুজ-শ্যামল চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান আবদুল হক চৌধুরী জন্মেছিলেন দেশ ভাগের বহু আগে, ১৯২২ সালের ২৪ আগস্ট। এই নগর-শহর-গ্রাম তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াজিশপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এরপর তিনি বহু অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছেন। জোগাড় করেছেন নানা অজানা তথ্য। যা পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের পাতায় পাতায় জায়গা করে নেয়।

আবদুল হক চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৪ সালের ২৬ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ১৯ বছর পর বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় আবদুল হক চৌধুরী রচনাবলি। এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আবদুল করিম। তিনি তাঁর লেখায় বলেন, ‘চট্টগ্রাম-আরাকান-সিলেটের ইতিহাস–ঐতিহ্যই ছিল আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণার ক্ষেত্র। তিনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু নতুন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তিনি রেখে গেছেন তাঁর অমূল্য কীর্তি।’

পুঁথি সংগ্রহ থেকে শুরু...

আবদুল হক চৌধুরীর বিভিন্ন বইপুস্তক ঘেঁটে তাঁর কাজের আগ্রহের কথা জানা যায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ভ্রমণপিপাসু ছিলেন। শৈশবেই বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা দাপিয়ে বেড়াতেন। বন্ধুবান্ধব মিলে চলে যেতেন দূরের কোনো গ্রামে। তাঁর পিতা মোহাম্মদ সরফুদ্দিন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। আবদুল হক চৌধুরী যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছেন, তখন বাবা মোহাম্মদ সরফুদ্দিন কাজের জন্য রেঙ্গুনে (বর্তমানে মিয়ানমার) ছিলেন। ঠিক ওই সময়েই তিনি রেঙ্গুনের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এরপর অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে এক সহপাঠীর সঙ্গে চলে যান কলকাতায়। এরপর আরও নানা জায়গায় ভ্রমণ করেন তিনি। আর ভ্রমণ করতে গিয়েই পুঁথি সংগ্রহের কথা মাথায় চলে আসে তাঁর। প্রথমেই তিনি প্রাচীন পুঁথি জোগাড়ে নেমে যান। অধ্যাপক আবদুল করিম লিখেছিলেন, ‘প্রাচীন পুঁথির চর্চা করতে গিয়েই আবদুল হক চৌধুরী ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। জন্মস্থান রাউজান, পার্শ্ববর্তী হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকার নামকরণ, ইতিহাস ও ভূগোল, প্রাচীন জমিদার ও ভূস্বামীদের খননকৃত দিঘি, নির্মিত মসজিদের ইতিহাস তাঁর গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ’ পুঁথিচর্চার পরপরই তিনি চট্টগ্রামের সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাহিত্য নিয়ে জানতে আটঘাট বেঁধে কাজে নেমে যান। হাজির করেন একের পর এক নতুন তথ্য। আর এ কাজ করতে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ দারুণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর সাহচর্যে আসার পর আবদুল হক চৌধুরী ইতিহাসচর্চায় আরও ঝুঁকে পড়েন।

একনজরে লেখালেখি

আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণার প্রশংসা করেছেন খ্যাতনামা শিক্ষক ও গবেষকেরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিম বলেছিলেন, ‘আবদুল হক চৌধুরী অবিরাম গতিতেই লিখে গেছেন। অনেক প্রবন্ধ ও বই লিখে প্রকাশ করেন।’

এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় তাঁর লেখালেখিতে। কত অজানা তথ্য যে তিনি তুলে এনেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা গ্রন্থে তিনি চট্টগ্রামের নামের উৎস নিয়ে লিখেন। চট্টগ্রামের নাম-উৎপত্তির সম্ভাব্য ১৭টি নামের উৎস-পরিচিতি তিনি তুলে এনেছিলেন তাঁর গ্রন্থে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো জ্বালনধারা, সামন্দর, শ্যাৎ-গাং, চিৎ-তৌৎ-গৌং, চাটিগ্রাম প্রভৃতি। আবদুল হক চৌধুরীর রচনাসমগ্র তিন খণ্ডে ভাগ করা যায়। প্রথম খণ্ডে ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ডে সমাজ ও সংস্কৃতি এবং তৃতীয় খণ্ডে চট্টগ্রাম-আরাকান নিয়ে নানা লেখা উঠে এসেছে। মোট ১২টি গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে তিনি এনামুল হকের কাছে গিয়েছিলেন। এক মাস পর এনামুল হক আবদুল হক চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘পাণ্ডুলিপি খুব ভালো হয়েছে। বই আকারে ছাপালে তিনি ভূমিকা লিখে দেবেন।’

সুজয় চৌধুরী: প্রথম আলোর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি