ইলিশের আকাল, হতাশ জেলেরা

সাগরে মিঠাপানির প্রবাহ কম। জেলেরা গত ১০ বছরের মধ্যে এই মৌসুমে সবচেয়ে কম ইলিশের দেখা পেলেন।

খালে ইলিশের নৌকা ঢুকতে শুরু করলে ব্যবসায়ী কিংবা তাঁদের লোকজন সাঁতার কেটে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। কে কার আগে ইলিশ কিনে নেবেন চলে সেই প্রতিযোগিতা। গতকাল বেলা তিনটার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাটেছবি: কৃষ্ণচন্দ্র দাস

একে একে সাগর থেকে জেলেদের নৌকা খালে ঢুকছে। ইলিশ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ সাঁতরে আবার কেউ গলাপানিতে নেমে ঘাটে ভেড়ার আগেই নৌকায় গিয়ে উঠছেন। তবে নৌকাগুলো তীরে এলে দেখা গেল কোনোটিতে ১০ কেজি আবার কোনোটিতে ৫ কেজি ইলিশ। মাছ না পাওয়ায় সাগরে পরিশ্রম বৃথা গেছে। ক্লান্ত জেলেদের চেহারায় তাই কষ্টের ছাপ। অন্যদিকে জেলেদের থেকে ইলিশ কিনতে আসা ব্যবসায়ীরাও হতাশ।

গতকাল রোববার বেলা দুইটা থেকে পৌনে চারটায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাটে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। ওই ঘাটের কুমিরা উত্তর ও দক্ষিণ গ্রামের জেলেদের দেড় শতাধিক নৌকা ভিড়েছিল তখন। সাগর থেকে ফিরে আসা জেলেরা জানান, মৌসুমের মাঝামাঝি এসেও ইলিশের এমন আকাল দেখা যায়নি এর আগের বছরগুলোতে। গত ১০ বছরের মধ্যে এই মৌসুমে সবচেয়ে কম ইলিশের দেখা পেলেন তাঁরা।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, চলতি বছরের প্রথম মৌসুমে গতকাল পর্যন্ত সীতাকুণ্ড উপকূলে ইলিশ ধরা পড়েছে ১৫০ টন। অথচ গত বছর মৌসুমের এমন সময় অর্থাৎ জুলাই–আগস্টে ইলিশ ধরা পড়েছিল ৪৭১ দশমিক ৫ মেট্রিক টনের মতো।

ইলিশ কম ধরা পড়া প্রসঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, সাগরে নদী থেকে মিঠাপানির একটা স্রোত থাকে। এ বছর মিঠাপানির এ প্রবাহ অনেক কম। পানির এই প্রবাহ না থাকলে ইলিশের ঝাঁক আসতে উৎসাহিত হয় না। এ জন্য এই বছর ইলিশের পরিমাণ অনেক কম।

শামীম আহমেদ আরও বলেন, চলতি মৌসুমে ইলিশের আরও তিনটি জো (মাছ ধরার উপযুক্ত সময়) আছে। এই তিন জোতে ইলিশের পরিমাণ বাড়তে পারে।

মাছ নিয়ে আসা অন্তত ২০ জন জেলে জানান, তাঁদের অনেকে এবার ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার ইলিশও বিক্রি করতে পারেননি। অনেকে ঋণ ও দাদন নিয়ে সাগরে জাল পেতেছেন। কিন্তু মাছ না ওঠায় ঋণের কিস্তি চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।

কুমিরা ঘাটে মাছ নিয়ে আসা কানাই জলদাস বলেন, তিনি সাগরে ২০টি ইলিশ জাল বসিয়েছেন। কিন্তু গতকাল দুপুর পর্যন্ত যে ইলিশ পেয়েছেন, তা বিক্রি করেছেন ১ হাজার ২০০ টাকায়। এর মধ্যে নৌকার জন্য ৮০০ টাকার জ্বালানি তেল কিনতে হয়েছে। তিনজন শ্রমিকের বেতন বাবদ খরচ হয়েছে আরও ১ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে তাঁর লোকসান হয়েছে ১ হাজার ১০০ টাকা।

তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইলিশ কম ধরা পড়লেও চাহিদা বেশি থাকায় লাভ হচ্ছে তাঁদের। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন বাজারে ইলিশ সরবরাহ করতে পারছেন না তাঁরা।

সীতাকুণ্ড থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজার, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, টাঙ্গাইল, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও রংপুরে ইলিশ পাঠান কুমিরা ঘাটের ব্যবসায়ী নুরুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর এ সময়ে তিনি নিজেই ট্রাক ভাড়া করে ইলিশ পাঠাতেন। কিন্তু এবার দিনে দুই থেকে পাঁচ খাঁচি (১০০ কেজি) ইলিশ সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ বাজারে ইলিশের চাহিদা অনেক। ইলিশ পাঠাতে দেরি হচ্ছে, কিন্তু বিক্রিতে সময় লাগছে না।

উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশনের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থেকে সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর পর্যন্ত ৫৩ হাজার পরিবার সাগরে মাছ ধরার কাজে সম্পৃক্ত।

ফেডারেশনের সভাপতি লিটন জলদাস বলেন, বাংলাদেশে যখন মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা চলে ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা তখন ঠিকই মাছ ধরেন। ফলে বাংলাদেশে ইলিশ কমছে। মৌসুমের এ সময়ে ইলিশের ঢল হতো। আর এবার গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ইলিশ ধরা পড়েছে।

লিটন জলদাস আরও বলেন, করোনায় বাংলাদেশের সব খাতে সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু মৎস্য খাতে প্রণোদনা তো দূরে থাক, কয়েক কেজি চাল ছাড়া জেলেদের ভাগ্যে আর কিছু জোটেনি।