ঈদের আগে জমজমাট সাপ্তাহিক বউ বাজার

ওয়ান–পিসের দোকানে উপচে পড়া ভিড়। গতকাল দিনাজপুর শহরের মালদহপট্টি এলাকায় বউবাজারে
ছবি: প্রথম আলো

থ্রি-পিস পছন্দ হওয়ার পর দরদাম শুরু করলেন এক নারী। দাম বেশি মনে হওয়ায় সামনে হাঁটা ধরলেন তিনি। তখনই পেছন থেকে বিক্রেতা ডাক দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের বিশ্বাস করেন, আপা। সীমিত লাভে সেল দিচ্ছি। এর আগেও তো মাল নিয়েছেন। এই মালটা নেন, জিতবেন।’ কথা শুনে আবার ফেরত এলেন ক্রেতা।

এদিকে পেছন থেকে হাঁকডাক শুরু হলো। ‘এই যে আপা আসেন, ২০০ টাকার মাল ৫০ টাকায়।’ দেখা গেল, মেয়েদের ওয়ান পিসগুলো ওলটাতে ওলটাতে হাঁক দিচ্ছেন বিক্রেতা।

এই হাঁকডাক শোনা যাবে দিনাজপুর শহরের মালদহপট্টি, বাসুনিয়াপট্টি, গরুহাটি, চুড়িপট্টির সড়কে বসা সাপ্তাহিক বউ বাজারে। শহরের চারুবাবুর মোড় হতে মালদহপট্টি মোড় পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার সড়ক। সড়কের দুই পাশে স্থায়ী কাপড়ের দোকান। শুক্রবার দোকানগুলো বন্ধ থাকায় সেখানে চার শতাধিক হকার বসেন এখানে। ওড়না থেকে থ্রি-পিস, শাড়ি, লুঙ্গি, প্যান্ট, শার্ট, জুতা, শিশুদের পোশাক, গজ কাপড়, বিছানার চাদর—সব পাওয়া যায় বউ বাজারে। ভোর থেকে শুরু হয়ে কেনাবেচা চলে বেলা তিনটা পর্যন্ত। দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় অনেক মানুষ আসেন সাপ্তাহিক বউ বাজারে কেনাকাটা করতে।

গতকাল সকালে বউ বাজারে ঘুরে দেখা যায়, পুরো সড়কে নারীদের ভিড়। বাজারে বাটিকের ওয়ান পিস বিক্রি হচ্ছে ৫০-৩০০ টাকায়। থ্রি-পিস পাওয়া যাচ্ছে ৩০০-৮০০ টাকায়। বিভিন্ন ধরনের গজ কাপড় ৫৫-৬৫ টাকা, ওড়না ১১০-১৮০, শাড়ি ২৫০-৬০০, বিছানার চাদর ২৫০-৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর বাহারি সব জুতা বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৫০ টাকায়।

শহরের রামনগর এলাকার বাসিন্দা আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, গতকাল বাহাদুর বাজার থেকে শাড়ি কিনেছেন। সেই শাড়ি নিয়ে ঘুরছেন বউ বাজারে। রং মিলিয়ে কিনবেন পেটিকোট ও ব্লাউজের কাপড়। এখানে কম দামে এসব পণ্য পান।

বাসুনিয়াপট্টি মোড়ে অগ্রণী ব্যাংকের সামনে আল আমিনের বাটিকের ওয়ান পিসের দোকান। প্রতিটি ওয়ান পিস বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। নুরনাহার বেগম ১৫০ টাকায় কিনলেন তিনটি। বললেন, ঈদের কেনাকাটা শেষ। বাড়িতে ব্যবহারের জন্য এগুলো কিনলেন। এখন ওড়নার দোকানে যাবেন। মিল করে ওড়না কিনবেন।

ব্যবসায়ীরা বলেন, এবার রোজার মধ্যে চারটা সপ্তাহ পাচ্ছেন। গতকাল ছিল তৃতীয় শুক্রবার। এবার রোজার শুরু থেকেই বউ বাজারে কেনাবেচা ভালো। ওড়না ব্যবসায়ী নাঈম হোসেন বলেন, করোনাকালে গত দুই বছর ব্যবসায় মন্দা গেছে। এবার ভালো ব্যবসা হচ্ছে। রমজানের শেষ সপ্তাহটা আরও বেশি বিক্রি হবে, এমনটাই প্রত্যাশা তাঁর।

নাঈম আরও বলেন, ‘৯ বছর ধরে বউ বাজারে ব্যবসা করতেছি। আগে মহাজনের দোকানে কাজ করতাম। কয়েক বছর হলো টুইন’স ওড়না ফ্যাশন নামে নিজেই দোকান দিয়েছি। তারপরও বাড়তি বিক্রির আশায় প্রতি শুক্রবার বউ বাজারে পসরা বসাই। এই বাজারের প্রতি মায়া বেশি। ব্যবসার শুরুটা যেহেতু এখান থেকেই।’

শিল্প ও বণিক সমিতির রাস্তার মুখে গজ কাপড় ও থ্রি-পিস বিক্রি করছেন বিশ্বনাথ দাস। পাশে বসা দিনাজপুর পলিটেকনিকে সিভিলে পড়ুয়া মেয়ে অর্পিতা। বলেন, ২০০৮ সালে এখানে ব্যবসা শুরু করেন। মাল কিনে বাড়িতে রাখেন। শুক্রবারে দোকান বসান। দুই বছর ধরে দোকানে মেয়ে তাঁকে সহযোগিতা করছেন।

বউ বাজারের ব্যবসায়ীরা দিনাজপুর দোকান কর্মচারী ইউনিয়ন বউ বাজার সমিতি গঠন করেছেন। বর্তমানে সমিতির সদস্যসংখ্যা ১৭৫। প্রতি সপ্তাহে সমিতিতে ২০ টাকা চাঁদা দেন তাঁরা। সেই টাকা অসুস্থ ব্যক্তি, পূজা-পার্বণসহ নানান সামাজিক কাজে ব্যয় করা হয়। সমিতির সভাপতি ভবানী আগরওয়াল বলেন, সমিতির সদস্য ১৭৫ জন হলেও দোকান বসে ৪ শতাধিক। স্থানীয় ব্যক্তিদের পাশাপাশি সৈয়দপুর, নীলফামারী, বগুড়া থেকেও মাল নিয়ে আসেন কেউ কেউ। যাঁরা একসময় কর্মচারী ছিলেন, তাঁদের অনেকে এখন নিজেই স্থায়ী দোকানের মালিক হয়েছেন। দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দিনাজপুরের বউ বাজার।