উঁচু জোয়ারে ৩২০ কিমি বাঁধের ক্ষতি

বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। স্থানীয় ব্যক্তিরা তা সংস্কার করছেন। গত বুধবার বিকেলে ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া কোড়ারহাট এলাকায়।প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর থেকে ভোলায় বিপৎসীমার ওপর দিয়ে জোয়ার বইছে। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৩২০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্থানে জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে বাড়িঘরে ঢুকছে। সর্বশেষ আজ বৃহস্পতিবারও জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, ভোলার চারদিকে যে বেড়িবাঁধ রয়েছে, তার উচ্চতা জোয়ারের উচ্চতার চেয়ে কম। তাই ভোলাবাসী দীর্ঘদিন ধরে পুরো বাঁধের সংস্কারের দাবি করে আসছে। কিন্তু পাউবো তাতে কান দিচ্ছে না। তারা শুধু জরুরিভাবে সাময়িক মেরামত করছে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে ভোগান্তি কমছে না।
সদর উপজেলার সোনাডুগি গ্রামের মো. হাসান বলেন, বাঁধ উপচে পানি পড়ার মতো উচ্চ জোয়ার খুব কমই হয়। এ বছর লাগাতার হচ্ছে। পাউবো বারবার সংস্কার করে পানি ঠেকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠেকাতে পারছে না।

বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে। গত বুধবার বিকেলে ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর এলাকায়।
প্রথম আলো

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভোলার চারদিকে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য বর্তমানে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। লোকে একে ‘শেখের বেড়ি’ নামে ডাকে। এত দিনে সে বাঁধের অনেকাংশ ভাঙনে বিলীন হয়েছে। যেটুকু আছে, সেটুকুও সংস্কারের অভাবে দুর্বল। শেখের বেড়ির পর যে বাঁধ নির্মাণ হয়েছে, তার মানও দুর্বল। চলতি বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সাড়ে ছয় কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা সংস্কার না করতেই ৫ আগস্ট উচ্চ জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় সাড়ে ৩২০ কিলোমিটার বাঁধ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এলাকার লোকজন জানান, ৫ আগস্টের পর জোয়ারের উচ্চতা একটু কমলেও পুরোপুরি কমেনি। প্রতিদিনই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে জোয়ার প্রবাহিত হচ্ছে। সর্বশেষ আজসহ গত তিন দিনের জোয়ারের উচ্চতাও ছিল অনেক বেশি। বাঁধ উপচে ও ভেঙে পানি ঢোকা ঠেকাতে পাউবো বারবার জরুরিভাবে বাঁধ সংস্কার করছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। এসব কাজ নিম্নমানের। দরকার টেকসই উন্নয়নের।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, ভোলায় জোয়ার তিন মিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেই তা বিপৎসীমা অতিক্রম করে। আম্পানের সময় বা তারপর তিন মিটারের ওপর দিয়ে জোয়ার প্রবাহিত হচ্ছে। ৫ ও ১৯ আগস্ট উচ্চতা ছিল সাড়ে চার মিটারের ওপর। অন্যদিকে ভোলার ৩২০ কিলোমিটার বাঁধের গড় উচ্চতা ৩ মিটারের একটু বেশি—৩ দশমিক ২ থেকে ৩ দশমিক ৩ মিটার। বাকি ৩০ মিটার বাঁধের উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার। এ অংশে বাঁধের গায়ে পাটা ব্লক দেওয়া আছে। এ কারণে এ এলাকায় জোয়ারে ক্ষতি হয় না।
পাউবো-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান বলেন, উচ্চ জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে জরুরি সংস্কারকাজ চলছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন, বাঁধ ভেঙে যেন পানি না প্রবেশ করে। জরুরি কাজের মান নির্ভর করে পানি ও ভাঙন ঠেকানোর ওপর। কী দিয়ে করা হলো, সেটি মুখ্য নয়।

গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি লঞ্চঘাট থেকে দক্ষিণে মুন্সিবাড়ি শাহবাজপুর পর্যটনকেন্দ্র পর্যন্ত চারটি স্থানে ব্লকবাঁধ ধসে যাচ্ছে। যে অংশে পাটা ব্লক আছে, জোয়ারে সেখানে ক্ষতি হয়নি। শাহবাজপুর পর্যটনকেন্দ্রের পর শিবপুর শান্তিরহাট পর্যন্ত বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা নিজেদের উদ্যোগে কোথাও বাঁধের ওপর বস্তা ফেলেছেন।
ধনিয়া শাপলাবাজারের বাসিন্দা মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘জোয়ারের তোড়ের কাছে মাটির এই বাঁধ তুচ্ছ মনে হচ্ছে। এ জোয়ার সামাল দিতে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ–উচ্চতায় আরও টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।’
পাউবো সূত্রে জানা যায়, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত ভোলার প্রায় ২২টি স্থানে সাড়ে ৬ কিলোমিটার বাঁধের জরুরিভাবে সংস্কার করা হয়। এসব এলাকা ও এর আশপাশের বাঁধের আবারও ক্ষতি হচ্ছে। জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে সদর উপজেলার রাজাপুর জোড়খাল; পূর্ব ইলিশার দালালবাজার মাছঘাট, সোনাডুগি, ধনিয়া, কোড়ারহাট, নাছিরমাঝি ও শিবপুর; দৌলতখানের চৌকিঘাটা, চরপাতা, মেদুয়া ও ভবানীপুর; বোরহানউদ্দিনের বড় মানিকা, মির্জাকালু, হাকিমউদ্দিন বাজার ও এছহাকমোড়সহ ১১টি স্থানে প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া মনপুরা ও চরফ্যাশনের সাতটি স্থানে সাড়ে চার কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়েছে।

পাউবো-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, বর্ষা মৌসুমে উত্তরের বন্যার পানি নামতে না নামতেই জোয়ার উঠছে। সঙ্গে আছে লঘুচাপ। এ কারণে জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে ভোলার সবটুকু বাঁধের উচ্চতা আট মিটার করা উচিত। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে সম্ভব হচ্ছে না।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, ৫ আগস্ট উচ্চ জোয়ারে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পর তাঁরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। গত বুধবার জোয়ারে আরও ক্ষতি হয়েছে। লাগাতার উচ্চ জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস হওয়ায় তিনি সমস্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে মন্ত্রণালয়ে লিখেছেন। বাঁধ উঁচু ও টেকসই করার পরামর্শ দিয়েছেন। ভোলায় সব উন্নয়নের চেয়ে এখন বাঁধের উন্নয়ন বেশি জরুরি।