রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থমথমে অবস্থা, উৎকণ্ঠায় বাসিন্দারা

কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গাশিবিরে এপিবিএনের একটি তল্লাশিচৌকি
ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার থাইনখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৮। আজ শনিবার সকাল ১০টার দিকে দেখা গেল, ক্যাম্পের রাস্তা ও অলিগলিতে টহল দিচ্ছে পুলিশ। ক্যাম্পের প্রবেশমুখগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। রোহিঙ্গারা বাইরে যেতে পারছে না, বাইরের কেউ ক্যাম্পের ভেতরে যেতে পারছে না। ক্যাম্পের ভেতরে চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান। ক্যাম্পের রাস্তাগুলো ফাঁকা, দোকানপাটগুলো বন্ধ। সব মিলিয়ে থমথমে অবস্থা।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে সন্ত্রাসীদের গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয় ছয় রোহিঙ্গা। এর মধ্যে পাঁচজন ক্যাম্প-১৮-এর রাস্তায় পাশে গড়ে তোলা ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্র। মাদ্রাসাটি রোহিঙ্গাদের সংগঠন ইসলামি মাহাস পরিচালনা করে থাকে।

প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা মাদ্রাসালাগোয়া মসজিদে ঢুকে তাহাজ্জতের নামাজ পড়তে যাওয়া রোহিঙ্গাদের এলোপাতাড়ি গুলি ও দা দিয়ে কোপানো শুরু করে। এতে ছয় রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। আহত হয়েছে অন্তত ১২ রোহিঙ্গা।

হামলায় নিহত ব্যক্তিরা হলো ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ মাদ্রাসার শিক্ষক ও বালুখালী ২ নম্বর শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইদ্রিস (৩২); বালুখালী ৯ নম্বর শিবিরের ব্লক-২৯-এর বাসিন্দা ইব্রাহীম হোসেন (২২); বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ ব্লকের বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবক আজিজুল হক (২৬), মোহাম্মদ আমিন (৩২); একই মাদ্রাসার শিক্ষক ও বালুখালী-১৮ নম্বর শিবিরের নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫) এবং মাদ্রাসাশিক্ষক ও ২৪ নম্বর শিবিরের হামিদুল্লাহ (৫৫)।

ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও হামলাকারীদের শনাক্ত এবং তাদের আটক করতে না পারায় উদ্বিগ্ন ক্যাম্পের হাজারো রোহিঙ্গা। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ক্যাম্পে মানবিক সেবায় কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর আশ্রয়শিবিরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।

হামলার ঘটনায় মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি’ বা আরসা (আল-ইয়াকিন নামেও পরিচিত) সরাসরি জড়িত বলে রোহিঙ্গা নেতারা দাবি করলেও পুলিশ বলছে, ক্যাম্পে আরসা কিংবা আল-ইয়াকিনের অস্তিত্ব নেই।

ক্যাম্পের পরিস্থিতি দেখতে গত শুক্রবার বিকেলে কক্সবাজারে যান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ডিআইজি মো. আজাদ মিয়া। ক্যাম্পের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চাইলে আজ শনিবার বেলা ১১টায় আজাদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ছয় রোহিঙ্গাকে হত্যার ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত চার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে। তারা আরসার নাম ব্যবহার করে ক্যাম্পে অপকর্ম চালায়। অন্যদের ধরতে ক্যাম্পে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ক্যাম্পের জনবল ও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

পুলিশ জানায়, হামলার ঘটনায় গতকাল শুক্রবার সকালে মুজিবুর রহমান নামের আরেক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছিল। তার কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, ছয়টি গুলি ও একটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, শুক্রবার রাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে ছয় রোহিঙ্গার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার মরদেহগুলো ক্যাম্পে নেওয়া হয়। রাত নয়টার দিকে থাইনখালী (ক্যাম্প-১৮) আশ্রয়শিবিরের কবরস্থানে মোহাম্মদ ইদ্রিস, ইব্রাহীম হোসেন, আজিজুল হক, মোহাম্মদ আমিন ও নুর আলম ওরফে হালিমকে এবং মাদ্রাসাছাত্র হামিদুল্লাহকে টেকনাফের লেদা আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-২৪) কবরস্থানে দাফন করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উখিয়া থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহমেদ সঞ্জুর মোর্শেদ।

থাইনখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) আবদুল মালেক বলেন, ঘটনার পর থেকে আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত হামলাকারীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে ব্লক রেইড চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চার-পাঁচজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে ধরেছে পুলিশ।রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। ক্যাম্পের প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে টহল দিচ্ছে পুলিশ। দোকানপাটও বন্ধ।

আরেক রোহিঙ্গা নেতা রহিম উল্লাহ বলেন, মাদ্রাসা ও মসজিদটিতে হামলার ঘটনায় জড়িত ছিল ৪০ থেকে ৫০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। কমবেশি প্রত্যেকের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো দা। সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছয় রোহিঙ্গা শিক্ষক-ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবী নিহত হয়েছে। এটি আরসার পরিকল্পিত হামলা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, হামলায় যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের কেউ ক্যাম্পে নেই। হামলার পরপর তারা থাইনখালী ক্যাম্পের বিপরীতে বালুখালী, রহমতের বিল ও ফালংখালী এলাকার বাইরে (নাফ নদীর মিয়ানমার নো ম্যানস ল্যান্ডে) পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের’ (এআরএসপিএইচ) কার্যালয়ে ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ (৪৮) বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন।