উখিয়া আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা নারীদের হাতে তৈরি পণ্যমেলা

কক্সবাজারের উখিয়া আশ্রয়শিবিরে আয়োজিত নারী উদ্যোক্তা মেলায় নিজেদের হাতে তৈরি পোশাক বিক্রি করছেন নারীরা। আজ দুপুরে কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের উইমেন মার্কেটে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের শরণার্থী নারীরা ঘরে বসে সেলাই মেশিনে বিভিন্ন ধরনের শার্ট, থামি লুঙ্গি, ব্লাউজ, কাঁথা, সোয়েটার ইত্যাদি তৈরি করেন। এসব পণ্যের ক্রেতাও রোহিঙ্গারা। আজ সোমবার এসব পণ্য নিয়ে উখিয়ায় কুতুপালং (ক্যাম্প-৫) আশ্রয়শিবিরে বসেছে ‘নারী উদ্যোক্তা মেলা’। দামে সস্তা ও টেকসই পণ্য পেয়ে রোহিঙ্গারা যেমন খুশি, তেমনি পণ্য বিক্রি করে লাভবান হওয়ায় নারীরাও পণ্য তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা সাড়ে ১১ লাখ। এর মধ্যে অল্পসংখ্যক নারী সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘরে বসে রকমারি কাপড়ের পোশাক তৈরি করছেন। ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা সেলাই করা কাপড়চোপড় পরতে অভ্যস্ত। রোহিঙ্গা নারীদের হাতে তৈরি পণ্য নিয়ে আশ্রয়শিবিরে এ ধরনের মেলার আয়োজন অতীতে চোখে পড়েনি।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের উইমেন মার্কেটে দিনব্যাপী এ মেলার আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা প্রান্তিক উন্নয়ন সোসাইটি পরিচালিত রোহিঙ্গা উইমেন অ্যান্ড এডোলেসেন্ট এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (রওয়া)। আজ সকাল নয়টায় মেলার উদ্বোধন করেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও আশ্রয়শিবিরের ইনচার্জ মাহফুজুর রহমান। মেলায় মোট ২১টি স্টল অংশ নিয়েছে। মেলা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

মাহফুজুর রহমান বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা রোহিঙ্গা নারীরা সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। নিজ হাতে তৈরি পণ্য বিক্রি দেখে তা অনুমান করা যায়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচির ফলে তাঁরা এখন আগের তুলনায় অনেক সচেতন। রোহিঙ্গা নারীদের সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে।

মেলার একটি স্টলে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন রোহিঙ্গা তরুণী রমিজা বেগম। তিনি ক্যাম্প-৫-এর সি-ব্লকের বাসিন্দা। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেন রমিজা। সঙ্গে ছিল মা ও ছোট চার ভাই–বোন। রমিজার বানানো পোশাক বিক্রি করেই তাঁদের সংসার চলে। রমিজার স্টলে সাজানো আছে শার্ট, হাফ প্যান্ট, ব্লাউজসহ নারী ও শিশুদের রকমারি পোশাক। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা দোকানে এসে কাপড়চোপড় কিনছে। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত রমিজার তিন হাজার টাকার কাপড় বিক্রি হয়েছে।

রমিজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, প্রান্তিকের মাধ্যমে তিনি সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখন ঘরে বসে শার্ট, থামি লুঙ্গি, ব্লাউজ তৈরি করছেন। এসব পোশাক বিক্রি করে তাঁর দৈনিক আয় হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। তা দিয়েই চলে সংসার। উইমেন মার্কেটে তাঁর একটি দোকান আছে বলে জানান তিনি।

নিজ হাতে তৈরি পোশাক বিক্রি করছেন এক রোহিঙ্গা নারী। আজ দুপুরে কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের উইমেন মার্কেটে
ছবি: প্রথম আলো

পণ্য কিনতে আসা রোহিঙ্গা নারী তসলিমা খাতুন (৪০) বলেন, পোশাকগুলো সুন্দর ও দাম কম। তিনি নিজের জন্য দুটি ব্লাউজ ও নাতির জন্য দুটি জামা কিনেছেন। আরেক রোহিঙ্গা শরণার্থী মো. কাশেম (৪৫) বলেন, বাংলাদেশিদের মতো রোহিঙ্গারা গার্মেন্টে তৈরি রেডিমেড পোশাক পরতে অভ্যস্ত নয়। সেলাই মেশিনে তৈরি পোশাক পরে ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও রেডিমেড পোশাক পরতেন না তাঁরা। সেখানে রেডিমেড কাপড় তৈরির কোনো কারখানা নেই বলে জানান তিনি।

প্রান্তিকের নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের কর্মকর্তা একরামুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ওব্যাট হেলপারস ইউএসএর সহযোগিতায় ‘প্রান্তিক’ স্থানীয় ও রোহিঙ্গা নারীদের কর্মদক্ষ করতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত করছে। রওয়াতে ৯৭ জন রোহিঙ্গা নারী সদস্য আছেন, যাঁদের বানানো পোশাক মেলায় বিক্রি হচ্ছে।

জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের অর্থায়নে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা নারীদের জন্য উইমেন মার্কেট প্রতিষ্ঠা করা হয়। উইমেন মার্কেটের ব্যবস্থাপক শেফালী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘টেকসই আগামীর জন্য জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’। এটিকে ধারণ করে মেলার আয়োজন। মেলার ২১টি স্টলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোহিঙ্গা নারীদের বানানো বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হচ্ছে। বেচাবিক্রি ভালো। মেলা দেখে বহু নারী সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন পোশাক তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।