একটি বিদ্যালয়ের ‘অপমৃত্যু’

পরিত্যক্ত সত্য নারায়ণ স্কুলের দুই পাশের জমি দখল করে গড়ে উঠেছে স্থাপনা। স্কুলভবন চেনা–ই দায়ছবি: প্রথম আলো

খুলনা নগরের দৌলতপুরে শিক্ষার বাতিঘর ছিল ‘সত্য নারায়ণ’ বিদ্যালয়। ব্রিটিশ আমলে সেটি ‘পাঠশালা’ ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয়করণ করা হয়। এরপর নাম হয় সত্য নারায়ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০০৭ সাল থেকে বিদ্যালয়টি বন্ধ। এখন সেখানে পড়াশোনার বালাই নেই।

দখল হয়ে গেছে বিদ্যালয়ের আশপাশের সব জমি। কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত দোতলা ভবনটি। ভবনের দেয়াল ঘেঁষে দুই পাশ দখল করে এমনভাবে স্থাপনা গড়ে উঠেছে, কেউ না বললে এটি যে বিদ্যালয় ভবন, তা আর চেনা যাবে না। যেন সবাই ভবনটির ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় আছেন। ভেঙে পড়লেই জায়গাটা দখলে নেবেন।

বিদ্যালয়টি দৌলতপুর স্টিমারঘাটের কাছে ভৈরব নদের পাশে। এর আশপাশে রয়েছে বেশ কিছু পাটগুদাম। নদের অপর পারেই দিঘলিয়া উপজেলা। ওই এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমল থেকেই এলাকাটি পাট ব্যবসার জন্য জমজমাট ছিল। গুদামগুলোকে ভিত্তি করে কয়েকটি শ্রমিক কলোনি গড়ে ওঠে। ওই কলোনির শিশুরা বিদ্যালয়টিতে পড়ত। ভৈরব নদ পার হয়ে দিঘলিয়া থেকেও অনেক শিশু এ বিদ্যালয়ে আসত।

দৌলতপুর থানা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সত্য নারায়ণ নামের এক ব্যক্তির বাড়ি ছিল সেটি। ১৯৪২ সালের দিকে তিনি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় পাঠশালা গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সত্য নারায়ণ পরিবার নিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর স্থানীয় লোকজন সেটিকে অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচালনা করতেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে সত্য নারায়ণের ১৫ শতক জমি নিয়ে ওই বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণ করা হয়। শিক্ষার্থী না থাকায় ২০০৭ সালে বিদ্যালয়টির সব শিক্ষককে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করে সেটিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

পরিত্যক্ত সত্য নারায়ণ স্কুলের দুই পাশের জমি দখল করে গড়ে উঠেছে স্থাপনা। স্কুলভবন চেনা–ই দায়
ছবি: প্রথম আলো

ওই বিদ্যালয়ের সর্বশেষ সহকারী শিক্ষক ছিলেন আবুল হোসেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই বিদ্যালয়ের সর্বশেষ প্রধান শিক্ষক ছিলেন জহির নামের এক ব্যক্তি। চাকরি থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এরপর আর কাউকে সেখানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সর্বশেষ তিনজনের মতো সহকারী শিক্ষক ছিলেন। বিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১০ থেকে ১৫ জন।

ওই সময় এক শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে এসে এমন অবস্থা দেখে বলেছিলেন, মাত্র এই কয়জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যায় না। এরপর শিক্ষকদের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বদলি করে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, দৌলতপুরের মহসিন মোড় থেকে পূর্ব দিকে চলে গেছে ভৈরব নদের স্টিমারঘাট। ঘাটের কাছেই আকাঙ্ক্ষা গ্রুপের বিশাল ময়দার কারখানা। কারখানা লাগোয়া একটি মসজিদ। মসজিদটির পূর্ব পাশের অংশ স্পর্শ করেছে বিদ্যালয় ভবনটিকে। মসজিদ ভবনের নিচের অংশে রয়েছে ইমামের থাকার ব্যবস্থা, ওপরের অংশে নামাজের স্থান। লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে সেখানে উঠতে হয়।
বিদ্যালয় ভবনের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনের পূর্ব দিকে টিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে জুট টেক্সটাইল মিলসের একটি পাটের গুদামঘর। আশপাশে থাকা কয়েক শ্রমিক ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে বিদ্যালয়টি সম্পর্কে কথা বলতে চাইলে সবাই ব্যাপারটি এড়িয়ে যান।

খুলনা নগরের সদর, সোনাডাঙ্গা ও দৌলতপুর থানা নিয়ে একটি প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়। ওই কার্যালয়ের শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সত্য নারায়ণ বিদ্যালয়ের নামে ১৫ শতক জমি রয়েছে। বর্তমানে ভবন বাদে প্রায় সবই প্রভাবশালীদের দখলে। ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। গত অক্টোবরে বিদ্যালয়টির সম্পত্তির সীমানা নির্ধারণ করার জন্য দিঘলিয়া উপজেলা ভূমি কার্যালয়কে চিঠি পাঠানো হয়েছে।