ছলছল চোখে জল, নিঃশব্দ কান্না

ভেতরে চিকিৎসা চলছে দগ্ধ ছেলে নয়নের। বাইরে অপেক্ষায় মা বুলবুলি বেগম। ৫ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা
তৌহিদুল ইসলাম

নারাণয়গঞ্জে মসজিদে ভয়বাহ বিস্ফোরণে ছেলে দগ্ধ হয়েছেন। ছেলের বন্ধুর কাছ থেকে মুঠোফোনে এই খবর পান বুলবুলি বেগম। পড়ি–মরি করে লালমনিরহাটের আদিতমারী থেকে ঢাকার পথে রওনা দেন । আনুমানিক ৫০ বছর বয়সী বুলবুলি সঙ্গে আনেন তাঁর এক ভাগনিকে। সারা রাত গাড়িতে চড়ে শনিবার সকাল ছয়টার দিকে ঢাকায় পৌঁছান। ছুটে যান শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। এরপর থেকে অপেক্ষায় আছেন, ভেতরে চিকিৎসাধীন ছেলের ব্যাপারে কখন ভালো সংবাদ শুনবেন।

সংবাদকর্মীদের সংবাদ সংগ্রহের ব্যস্ততা। ৫ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা
প্রথম আলো

দগ্ধ নয়ন (২৬) ভেতরে বার্ন ইউনিটের ভেতরে চিকিৎসাধীন। স্বজনদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। শনিবার বেলা দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত অভ্যর্থনা কক্ষের এক কোণায় বিষণ্ণ মনে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেল বুলবুলিকে। চোখে ছল–ছল, জল। নিঃশব্দ কান্নায় কিছুক্ষণ পরপর মুষড়ে যাচ্ছেন। আর বলছেন, 'একনা ছাওয়া কামাই করছিল। স্বামী মোর মেনটাল, পাগলা। ছাওয়াটার যে এলা কী হইবে কায় জানে। এলা মুই কী করিম?'

বিস্ফোরণে দগ্ধ ইব্রাহিম বিশ্বাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। শোকাহত বোন মাহমুদা আক্তার। ৫ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা
প্রথম আলো

চিকিৎসকদের কাছ থেকে বুলবুলি শুধু এইটুকু জানতে পেরেছেন। তাঁর ছেলে এখনো বেঁচে আছেন, চিকিৎসা চলছে। বুলবুলি বেগমের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বাড়ি আদিতমারী উপজেলার তালুক পলাশী গ্রামে। তাঁর স্বামী মেহের আলী মানসিক ভারসাম্যহীন। কোনো কাজ করতে পারেন না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী বড় ছেলে নয়ন। যে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে এখন জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট দুই ছেলে বাড়িতেই থাকে।

গেটের সামনে পুলিশি পাহারা। ৫ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা
ছবি: প্রথম আলো

বেলা পৌনে দুইটার দিকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে ফটকের সামনে দেখা যায় পুলিশি পাহারা। সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। গেট পেরিয়ে অভ্যর্থনা কক্ষে অনেক মানুষের ভিড় চোখে পড়ল। দগ্ধ রোগীদের স্বজনেরা সেখানে অপেক্ষমাণ। সংবাদকর্মীদের ব্যস্ততা লক্ষ্য করা গেল। তবে কিছু উৎসুক মানুষের জটলাও আছে।

দগ্ধ রোগীর স্বজনদের খাবার দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। ৫ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা
প্রথম আলো

মানুষের গমগম শব্দে স্বজনদের আহাজারি এখানে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে এক নারীকে কাঁদতে দেখে কাছে গিয়ে জানা গেল, চিকিৎসাধীন অবস্থায় দগ্ধ ইব্রাহিম বিশ্বাস মারা (৪৫) গেছেন। সেই শোকে কাঁদছেন বোন মাহমুদা আক্তার। তাঁর ছেলে উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শয়েব মাহমুদ (১৮) বলেন, 'মামার লাশ এখনই অ্যাম্বুলেন্সে করে নারায়ণগঞ্জে নেওয়া হবে।'

সাত বছরের ছেলে জুবায়েরকে হারিয়ে শোকে কাতর মা রহিমা বেগম। ৫ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা
ছবি: প্রথম আলো

এ দিকে শুক্রবার রাত থেকে দগ্ধ রোগীদের স্বজনদের দেখভাল করছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাকওয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। রোগীদের স্বজনদের পাউরুটি, কলা ও পানি দিচ্ছেন তাঁরা। সেখানে কথা হলো সংগঠনটির চেয়ারম্যান গাজী ইয়াকুবের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে দগ্ধ রোগী ও স্বজনদের অ্যাম্বুলেন্সে করে আনা নেওয়া করছেন তাঁরা। কেউ মারা গেলে তাঁর লাশ বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন।

নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকায় শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রায় অর্ধশত মানুষ দগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধ ব্যক্তিদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, মসজিদের সামনের গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে। এ পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন