এক কেন্দ্রে ২০ হাজার স্বাভাবিক প্রসব

স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের জন্য প্রসিদ্ধ গাইবান্ধা মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রটি। প্রতিষ্ঠানটি ১১ বার জাতীয় ও ১ বার বিভাগীয় পুরস্কার পেয়েছে।

গাইবান্ধা মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের মূল ভবনছবি: প্রথম আলো

স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসবসেবায় নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে গাইবান্ধা মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্রোপচার ছাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নারীদের সন্তান প্রসবে সহায়তা করে। গত সাত বছরে এই কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯১১ অন্তঃসত্ত্বার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব হয়েছে।

গাইবান্ধা মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ১৯৪০ সালের ১ জানুয়ারি জেলার প্রধান প্রসূতিসেবা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। ২০ শয্যাবিশিষ্ট কেন্দ্রটি শহরের মাস্টারপাড়ায় অবস্থিত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গতানুগতিক নিয়মে চলছিল প্রসূতিসেবা কেন্দ্রটি। কিন্তু ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে আফছারী খানম এখানে মেডিকেল কর্মকর্তা (ক্লিনিক) পদে যোগদানের পর দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। তাঁর মূলমন্ত্রই ছিল দরিদ্রদের প্রসূতিসেবা দেওয়া। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসবসহ প্রসূতিসেবার জন্য ১৫ বছরে কেন্দ্রটি ১১ বার জাতীয় পুরস্কার ও ১ বার বিভাগীয় পুরস্কায় পায়। গত বছরের ১৫ অক্টোবর লালমনিরহাট জেলায় বদলি হয়ে যান আফছারী খানম। তাঁর সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রটির অন্যরা।

আফছারী খানম বলেন, গাইবান্ধা নদীভাঙনকবলিত দরিদ্র এলাকা। তিনি সেবা দিতে গিয়ে দেখেছেন, এখানকার নারীরা অনেকটাই চিকিৎসাবঞ্চিত। তাই স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করানোর কথা ভাবেন তিনি।

মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এখানে ১ হাজার ৫৮৪ অন্তঃসত্ত্বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করেছেন। এর আগে ২০২০ সালে ২ হাজার ২৯৩, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৩০০, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ২৯৩, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৯৬৪, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ১২১, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩৫৬ জনসহ ৬ বছরে ১৯ হাজার ৯১১ জন অন্তঃসত্ত্বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করেন এখানে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবও হয়েছে এই কেন্দ্রে। ৬ বছরে ৫১২টি অস্ত্রোপচার হয়েছে।

পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক ডলি আক্তার জানান, এ কেন্দ্রে আরও দুজন নার্স ও দুজন সহকারী নার্স দরকার।

মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রে অনুমোদিত পদ আছে ১৩টি। বর্তমানে ২১ জন কর্মরত। এর মধ্যে আটজন প্রেষণে আছেন। তবে বদলির কারণে এক বছর ধরে গাইনি চিকিৎসকের (মেডিকেল অফিসার, ক্লিনিক) পদটি শূন্য। দুজন মেডিকেল কর্মকর্তা (এমসিএইচ-এফপি) থাকলেও তাঁরা ১২ সেপ্টেম্বর পদোন্নতি পেয়েছেন। ফলে মেডিকেল কর্মকর্তার পদ দুটিও শূন্য।

স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা ছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য কার্যক্রমে কেন্দ্রটির উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। গত ১ বছরে এখানে ৫ হাজার ৩২২ জনকে গর্ভকালীন পরিচর্যা, ২ হাজার ৩৩০ জনের প্রসব–পরবর্তী পরিচর্যা এবং ৩ হাজার ৪৪৪ শিশুর পরিচর্যা করা হয়।

সম্প্রতি সরেজমিনে কেন্দ্রটিতে সেবা নিতে আসা নারীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। কেউ মাতৃসেবা, কেউ শিশুদের সেবা নিতে এসেছেন। কিশোরীদেরও সেবা দেওয়া হচ্ছে। পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস, কক্ষগুলো পরিপাটি। কেন্দ্রে ঢুকতেই ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, নিচতলায় রোগীদের বসার ব্যবস্থা, সাধারণ রোগীর সেবা, গর্ভবতী মায়ের সেবা, দ্বিতীয় তলায় স্বাভাবিক প্রসব ও অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা, তৃতীয় তলায় কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।

সেবা নিতে আসা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের ফারজানা খাতুন (২৫) জানান, তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সরকারি এই কেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা নিয়ে তিনি খুশি। আগের মতো ভোগান্তি নেই। একই কেন্দ্রে আসা সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম গ্রামের লিমা বেগম (৩০) বলেন, আগে প্রসববেদনা উঠলেই অস্ত্রোপচারের কথা বলা হতো। এখন এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রসব করানো হচ্ছে। বিনা মূল্যে এই সেবা পেয়ে তিনি আনন্দিত।

জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই কেন্দ্রে শূন্য পদে লোকবল দিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন আ ক ম আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সাত বছরের যে হিসাব দেখিয়েছেন, তা ঠিক আছে।