এক টাকার শিঙাড়ায় সংগ্রাম

করোনার মধ্যেই দোকান চালু করলেন। সেই থেকে শিঙাড়া বিক্রি করে এখন সংসারের হাল ধরেছেন শক্ত হাতে।

রাজশাহী নগরের সাধুর মোড়ে এক টাকার শিঙাড়া বিক্রি করে সংসার চালান মোনোয়ারা বেগম। দুই ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন
ছবি: প্রথম আলো

২০২০ সালের মার্চের এক রাত। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। দুই ছেলেকে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে চোখে ঘুম আসছিল না মোনোয়ারার (৩৩)। পাঁচ মাসের বাড়িভাড়া বাকি। দুই ছেলের স্কুলের বেতন বাকি। ঘরে নেই চাল-ডাল। এই চিন্তায় তিনি ডুকরে কাঁদতে শুরু করেন। বড় ছেলে মাইনুল মাকে হঠাৎ বলে উঠল, ‘চলো মা, আমরা তিনজনে রেললাইনে যাই। ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়ি। আর ট্রেনটা আমাদের ওপর দিয়ে চলে যাক।’ এই কথায় তিন মা-ছেলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন।

করোনার প্রথম প্রকোপের বিধিনিষেধ চলছিল তখন। সে সময়ের এক দিনের কথা প্রথম আলোকে বলছিলেন মোনোয়ারা বেগম, সংসারের টালমাটাল অবস্থায় যখন একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। দুই বছর ব্যবধানে মোনোয়ারার সেই দিন আর নেই। এখন আর তাঁর সংসারে অভাব নেই। দুই ছেলেকে নিয়ে শুরু করেছেন এক টাকার শিঙাড়া বিক্রির ব্যবসা। রাজশাহী নগরের সাধুর মোড় এলাকায় তাঁর দোকান। সেখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। কোনো কোনো দিন ১৫ হাজার শিঙাড়াও বিক্রি করেন তিনি। বড় ছেলে মাইনুল (১৭) পড়ছে দ্বাদশ শ্রেণিতে। আর ছোট ছেলে সুলাইমান (১৬) পড়ছে দশম শ্রেণিতে।

শিঙাড়া ভাজছেন মোনোয়ারা বেগম
ছবি: সংগৃহীত

শৈশব থেকে কেটেছে কষ্টের জীবন

মোনোয়ারার বাবার বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার চকগোবিন্দপুর গ্রামে। ২০০০ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। ছেলেকে না দেখেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন সেদিন। সংসারে গিয়ে দেখেন, স্বামী মাদকাসক্ত। বিয়ের তিন বছরের মাথায় দুই ছেলের জন্ম। সংসারে মন নেই স্বামীর। উল্টো প্রতিদিনই মারধর করতেন মোনোয়ারাকে। দুই ছেলেকে নিয়ে একদিন বাবার বাড়িতে চলে আসেন তিনি। পড়ালেখা চালিয়ে যান। কিন্তু অসুস্থতার কারণে এসএসসিতে দুটি পরীক্ষা দিয়েই থেমে যান। বাবা-ভাইয়ের সংসারে অভাব-অনটনের মধ্যে সেখানেও থাকা হয় না। ২০০৭ সালে দুই ছেলেকে নিয়ে পাড়ি জমান রাজশাহী শহরের নওদাপাড়ায়। সেখানে বাসাবাড়িতে কাজ করে বড় ছেলের লেখাপড়া চালাতে থাকেন।

একবার মাদকাসক্ত স্বামী সেখানে আসেন তাঁকে ফিরিয়ে নিতে। যেতে চাননি বলে চুলের মুঠি ধরে মারপিট করেন। এর মধ্যে হঠাৎ তাঁর বড় ছেলে ‘নিখোঁজ’। পরে খবর নিয়ে জানলেন, তাঁর স্বামী বড় ছেলেকে নিয়ে চলে গেছেন। এ নিয়ে এলাকায় ২০১৫ সালে সালিস হয়। সালিসে মোনোয়ারা শর্ত দেন, স্বামীকে মাদক ছাড়তে হবে। স্বামী রাজি হন না। তখন তিনি স্বামীকে ভরা সালিসে তালাক দেন। মোনোয়ারা বলেন, তখন অনেকেই বলছিলেন, মেয়ে মানুষের এত জেদ ভালো নয়। কিন্তু কেন সংসার ছাড়লেন, কোন পরিস্থিতিতে ১৫ বছরের সংসার ছাড়তে হলো, তা কেউ বুঝতে চান না।

এক টাকার শিঙাড়ায় ভাগ্যবদল

২০২১ সালের এপ্রিলের কথা। একদিন বড় ছেলেই তাঁকে ইউটিউবে শিঙাড়া বানানোর কলাকৌশল দেখিয়ে বলল, শিঙাড়া বানিয়ে বিক্রি করলে কেমন হয়। কথাটা মনে ধরল মোনোয়ারার। কিন্তু কে তাঁকে দোকান ভাড়া দেবে। অবশেষে বাসার মালিকের সাহায্যে ৭০০ টাকা ভাড়ায় দোকান পেলেন। শর্ত, শুরুতে দিতে হবে ৫ হাজার টাকা জামানত। কিন্তু মোনোয়ারার কাছে ছিল মাত্র ২ হাজার ৭০০ টাকা। ধারদেনা করে দোকান ভাড়া নিলেন। কিন্তু দোকান চালানোর মতো টাকাপয়সা তো নেই। বড় ছেলেকে বললেন, এক সপ্তাহ টানা রাজমিস্ত্রির কাজ করতে। এই সময়ে তিনিও বাসাবাড়ির কাজ আর নিজের শেখা টেইলার্সের কাজ করে কিছু টাকা জমালেন। সেই টাকা দিয়ে শিঙাড়া তৈরির কড়াইসহ অন্যান্য সামগ্রী কিনলেন। প্রথমে ১০০ শিঙাড়া বানিয়ে আশপাশের পরিচিতদের খাওয়ালেন। ওই দিনই ৭০০-এর মতো শিঙাড়া বিক্রি হয়ে গেল। করোনার সংকটের মধ্যেই দোকান চালু করলেন। সেই থেকে শিঙাড়া বিক্রি করে এখন সংসারের হাল ধরেছেন শক্ত হাতে।

মোনোয়ারা বলেন, এমনও দিন যায়, ১৫ হাজারের মতো শিঙাড়া বিক্রি করেন। দোকানে কর্মচারীও রেখেছেন। ছয় হাজার টাকা মাসিক বেতনে ৫-৭ জন শ্রমিক খাটেন তাঁর দোকানে। মোনোয়ারা বলেন, এখন জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এক টাকায় শিঙাড়া বানিয়ে দিতে কষ্ট হয়। কিন্তু লাভ কম হলেও, তিনি এক টাকাতেই বিক্রি চালিয়ে যাবেন।

মোনোয়ারা বলেন, এখন এই ব্যবসাকে আরও বড় করতে চান। নিতে চান বড় দোকান, যেখানে ক্রেতারা বসে শিঙাড়া খেতে পারবেন।

স্বীকৃতি

সংসারে অভাব ঘোচানোর অদম্য প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে মোনোয়ারা শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে ২০২১ সালে রাজশাহী জেলা পর্যায় জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন। তবে মোনোয়ারা বলেন, নারী বলে এখনো কটু কথা শুনতে হয় তাঁকে। কিন্তু তাঁর ছেলেরা এখন মায়ের কষ্ট বোঝে। চোখের জল মুছিয়ে দেয় তারাই। দুই ছেলেই মায়ের কাজকে সম্মান করে, সব সময় কাজে সহযোগিতা করে।

মোনোয়ারা বলেন, লেখাপড়ার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর। স্কুলের সহপাঠীরা এখন অনেকেই সরকারি চাকরি করেন। তাঁদের সংসারে প্রাচুর্য দেখে খুব আফসোস হয় মাঝেমধ্যে। কিন্তু এই সব আবার মুহূর্তেই ভুলে যান ছেলেদের দিকে তাকিয়ে। তিনি বলেন, নারীদের খুব নীচু চোখে দেখা হয়। কিন্তু থেমে থাকা যাবে না। অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু ওই পথ ছাড়া আরও বহু পথ খোলা আছে। সেই পথে নারীদের যাওয়ার আহ্বান মোনোয়ারার।