এক পাতে ধনী–গরিব

বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার করছেন। গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদে।
ছবি: প্রথম আলো

বেঁটে-খাটো ও শীর্ণ চেহারার আবুল কালামের বয়স ষাটের কোঠায়। প্লেটে প্লেটে ইফতারি সাজানোর পর মসজিদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জোরে হাঁক দিলেন তিনি, ‘আসেন আসেন, সবাই শরিক হয়ে যান।’ আবুল কালামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মসজিদজুড়ে বিছানো দস্তরখানায় একে একে এসে বসতে লাগলেন রোজাদাররা। ভিখারি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সবাই এক কাতারে।

সোমবার চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার শাহি জামে মসজিদে গণ–ইফতারে শামিল হয়েছিলেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। গত ১৪ বছর চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদে এমন আয়োজন হচ্ছে। ইফতারের এই মহা আয়োজন দেখতেই বিকেল চারটা নাগাদ আমরা হাজির হয়েছিলাম মোগল বিজয়ের স্মারক হিসেবে তৈরি শাহি জামে মসজিদে।

ঐতিহাসিক এই মসজিদ দিল্লির জামে মসজিদের আদলে তৈরি। মগ ও পর্তুগিজদের কবল থেকে চট্টগ্রামের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে দিল্লির বাদশাহ আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ওই মসজিদ নির্মাণ করেন। এখানকার মুসল্লি ও খাদেমরা জানান, তৈরির পর থেকেই রোজায় ইফতারের আয়োজন চলছে এখানে। তবে বড় পরিসরে গণ–ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে ২০০৮ সাল থেকে।

খোলা বড় চত্বর আর জাফরিকাটা খিলানের সাবেকি মসজিদে পা দিতেই মন শান্ত হয়ে আসে। বিকেল চারটায় আমরা যখন সেখানে যাই, তখন প্লেটে প্লেটে ইফতারি পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবক। তবে ইফতারি তৈরির কাজ শুরু হয় সেই সকাল আটটায়। ১০ জন বাবুর্চি ছোলা, পাকোড়া, শিঙাড়া, পেঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, চপ আর চিড়া তৈরির কাজ শুরু করেন। বড় তিন ডেক আর তিনটি কড়াইয়ে রান্নার আয়োজন চলেছে দুপুর পর্যন্ত। এ ছাড়া বড় একটি প্লাস্টিকের ড্রামে তৈরি হয়েছে বরফ আর লেবুর শরবত।

স্বেচ্ছাসেবক আবুল কালাম ১০-১২ বছর ধরে এই ইফতার আয়োজনে সহযোগিতা করে আসছেন। রোজার সময় সকাল থেকেই কাজে লেগে পড়েন তিনি। রান্নার তদারকি, খাবার বণ্টন আর পরিবেশনে সহায়তা করেন তিনি। আবুল কালাম বলেন, ‘কেউ আমারে ডাকে না। নিজ থেইকাই এই হানে আইয়া পড়ি। সবাইরে খাওয়ানোর কামটা খুব ভালো লাগে। কাজ শেষ হইলে এখানেই শুইয়া পড়ি।’

নিবেদিতপ্রাণ আবুল কালামের মতো অনেকেই এই ইফতার আয়োজনে নিঃস্বার্থভাবে সহায়তা করেন। মসজিদের খতিবের একান্ত সচিব মো. হাসান মুরাদ এই আয়োজনের খুঁটিনাটি দেখভাল করেন। তিনি বলেন, ‘এই আয়োজনের পুরোটাই আসে দানের টাকা থেকে। বেশির ভাগ মানুষই নিজের নাম প্রকাশ করতে চান না। গতকালই একজন ফোন করে বললেন, এক ট্রাক ছোলা, ডাল আর তেল পাঠিয়েছেন, সেগুলো গ্রহণ করতে। ট্রাকে করে এসব জিনিস আমাদের দিয়ে যাওয়া হলো; কিন্তু জানলাম না তাঁর পরিচয়। এখানে মসজিদের এক টাকাও খরচ হয় না।’

ইফতার আয়োজনের পাশেই বড় ড্রামে শরবত তৈরি করছিলেন মো. শহীদ আলম। এক ব্যবসায়ীর কর্মচারী তিনি। কথায় কথায় জানান, ওই ব্যবসায়ী প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষের জন্য শরবতের আয়োজন করছেন। গতকালও দেড় হাজার মানুষের জন্য শরবত তৈরি করেছেন তিনি।

বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মসজিদ প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেউ বসেছেন কাতারে আর কেউ গোল হয়ে। বইয়ের দোকানের কর্মচারী, সিকিউরিটি গার্ড, ব্যাংকার, গ্রাফিক ডিজাইনার থেকে শুরু করে রিকশাচালক এমন হরেক পেশার লোকজনকে দেখা গেল গণ–ইফতারে।

মিম্বরের মুখোমুখি একেবারে মাঝখানের কাতারে বসেছিলেন মো. নয়ন। তাঁর বাঁ হাতটি বাঁকা। সেটি পেছনের দিকে নিয়ে তিনি বললেন, ‘ভিক্ষা করে চলি। এখানে আসলে বড় ভালো লাগে। মনটা শান্ত হয়।’ নয়নের পাশেই বসেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাসিফ খান। নগরের খুলশীতে বাসা তাঁর। ভাইকে নিয়ে এখানে এসেছেন মসজিদে ইফতার করবেন বলে। নাসিফ বলেন, ‘এখানকার পরিবেশটাই আলাদা। তাই দেখতে এলাম। ইফতারের আয়োজনে এসে সত্যি খুব ভালো লাগছে।’

চন্দনপুরা থেকে তানভির হোসেন এসেছেন এখানে বিশেষ কাজ পড়ে যাওয়ায়। বিদ্যুৎ মিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে পাওয়া গেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র মো. জায়েদ, চাকরিজীবী মো. হোসেন ও এনামুল হককে।

একটি বড় থালায় ছোলা, মুড়ি, বেগুনি ও জিলাপি মাখানো হয়েছে। সেগুলো সবাই খাবেন। কেমন লাগছে, জানতে চাইলে তানভির বলেন, ‘যাঁদের সঙ্গে বসে খাচ্ছি, তাঁদের কাউকে আগে চিনতাম না। এখানে পরিচয়। খাবারের থালা আমাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে দিয়েছে। এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে।’