এমনও প্রেম হয়...

ঝিনাইদহের কোদালীয়া গ্রামে সংসার পেতেছেন সলেমান শেখ ও সমাপ্তি খাতুন
ছবি: প্রথম আলো

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সলেমান শেখের (৩৪) সঙ্গে মুঠোফোনে পরিচয় হয় জেলার শৈলকুপা উপজেলার সমাপ্তি খাতুনের (২৫)। এক সময় একে অন্যের প্রেমে পড়েন। তিন বছর সম্পর্ক চলার পর হঠাৎ করেই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর ছয় মাস পর সমাপ্তি জানতে পারেন, এক দুর্ঘটনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকার সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে (সিআরপি) চিকিৎসা নিচ্ছেন সলেমান। দুর্ঘটনায় হারিয়ে ফেলেছেন সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। বাকি জীবন কাটাতে হবে হুইলচেয়ারে।

এসব জানার পরও সলেমানকেই বিয়ে করবেন বলে মনস্থির করেন সমাপ্তি। বাদ সাধেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এরপর পালিয়ে বিয়ে করে এই জুটি। এখন তাঁরা একসঙ্গে সংসার করছেন।

সলেমান শেখ সদর উপজেলার কোদালীয়া গ্রামের মৃত ইনছার আলী শেখের ছেলে। সমাপ্তি খাতুন শৈলকুপা উপজেলার ব্যাসপুর গ্রামের মন্টু বিশ্বাসের মেয়ে। কোদালীয়া গ্রামে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকান রয়েছে সলেমানের। হুইলচেয়ারে আসা–যাওয়া করেন দোকানে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায়–সম্বল হারিয়েছেন সলেমান। এখনো নিয়মিত চালিয়ে যেতে হচ্ছে ওষুধ। ব্যবহার করতে হয় ক্যাথেটার।
২০১৬ সালে সলেমান শেখকে বিয়ে করার পর থেকে তাঁর সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন জানিয়ে সমাপ্তি খাতুন বলেন, ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সলেমানের সঙ্গে মুঠোফোনে পরিচয় হয় তাঁর। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। ২০১৫ সালের ৯ মে থেকে সলেমানের মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পেতে থাকেন সমাপ্তি। এরপর বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেননি। ছয় মাস পর ওই বছরের নভেম্বরে সলেমানের মুঠোফোন নম্বর সচল পান এবং তাঁদের মধ্যে কথা হলে পুরো ঘটনা জানতে পারেন সমাপ্তি।

তখন মাত্র সিআরপি থেকে বাড়ি ফিরেছেন জানিয়ে সলেমান বলেন, কয়েক দিন কথা বলার পর সমাপ্তি তাঁকে বিয়ে করতে চান। নিজের শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দিতে চাননি। কিন্তু সমাপ্তির পীড়াপীড়িতে বিয়েতে রাজি হন।

সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করতে করতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন সমাপ্তি। বলেন, পরিবারের সদস্যরা সব জানার পর বিরূপ হয়ে ওঠেন। এরপর তাঁর বিয়ের জন্য পাত্র দেখতে শুরু করেন। সলেমানকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবেন না বলে পরিবারকে জানিয়ে দেন। পরিবারের সদস্যরা কোনোভাবেই বিষয়টি মানতে না চাইলে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর বাড়ি ছেড়ে সলেমানের বাড়িতে চলে আসেন। ওই দিনই তাঁদের বিয়ে হয়।

দুর্ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ম্রিয়মাণ হয়ে যান সলেমান শেখ। তিনি বলেন, বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে হাত লাগার পর ছিটকে পড়েছিলেন। আশপাশের লোকজন ভেবেছিলেন, তিনি বিদ্যুতায়িত হয়েছেন। এরপর তাঁকে পেটাতে ও পাড়াতে থাকেন তাঁরা। এতে তাঁর মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। প্রথমে ঝিনাইদহে, পরে ফরিদপুর ও ঢাকা হয়ে সর্বশেষ সাভার সিআরপিতে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসায় প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। এ জন্য সাত বিঘা কৃষিজমি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন আর কোনো সহায়–সম্বল নেই তাঁর। সংসার চালাতে গ্রামে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকান দিয়েছেন।

দোকানে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয় জানিয়ে সলেমান বলেন, এখনো তাঁকে ক্যাথেটার ব্যবহার করতে হয়। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। সব মিলিয়ে মাসে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাগে।

হুইলচেয়ারে করে দোকানে আসা-যাওয়া করেন। এ ক্ষেত্রে আবদুল আলিম নামের একজন তাঁকে সহযোগিতা করেন জানিয়ে সলেমান বলেন, দোকান দিতে ও সংসার চালাতে গিয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ধার করেছেন। এখনো তা পরিশোধ করতে পারেননি। আশা ছিল, দোকান ভালোভাবে চললে খেয়ে–পরে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু টাকার অভাবে মালামাল তুলতে পারছেন না।

সমাপ্তির কথা ভেবে কষ্ট হয় উল্লেখ করে সলেমান বলেন, ঢাকার চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, ‘তিন লাখ টাকা খরচ করলে টেস্টটিউব পদ্ধতিতে মা হতে পারবে সমাপ্তি। টাকার অভাবে সেটাও করা যাচ্ছে না। ওকে আর কত কষ্ট করতে হবে কে জানে।’

সলেমানকে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন জানিয়ে হরিশংকরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, ঘটনাটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। সলেমানকে ভালোবেসে মেয়েটি (সমাপ্তি) যে ত্যাগ স্বীকার করেছে—তা এ জগতে বিরল।