কক্সবাজার সৈকতে ঝুঁকি নিয়ে গোসল, প্রশাসনের ১০ নির্দেশনা

কক্সবাজার সৈকতে গোসলে নামতে নিষেধ করে ওড়ানো হচ্ছে লাল নিশান। তবু তোয়াক্কা করছেন না অনেকে। শনিবার দুপুরে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল এখন উত্তাল। তারপরও জোয়ার-ভাটার হিসাব না করে সমুদ্রে গোসলে নামছেন ভ্রমণে আসা পর্যটকসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। এতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গত দুই দিনে সৈকতে ভেসে আসে তিনজনের মরদেহ। তাঁদের মধ্যে দুজন ভ্রমণে আসা পর্যটক বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঝুঁকি নিয়ে গোসলে নেমে এই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা লাইফগার্ডের কর্মীদের।
এর আগে গত ২৬ জুন ও ৮ সেপ্টেম্বর সৈকতে গোসলে নেমে গুপ্তখালে আটকা পড়ে মারা যায় বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলপড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী।

প্রাণহানি থেকে পর্যটকসহ লোকজনকে বাঁচাতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয়েছে ১০ দিনব্যাপী বিশেষ জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি। শুক্রবার বেলা ১১টায় সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। ভ্রমণে আসা পর্যটকেরা ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়ে গোসলে নামার নিয়মকানুন জেনে নিচ্ছেন। ‘পানিতে নামার পূর্বে করণীয়’ শীর্ষক এই কর্মসূচিতে পর্যটকদের জন্য ১০টি নির্দেশনা জারি করে জেলা প্রশাসন। সৈকতের লাবণী, সি–গাল, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে এই নির্দেশনা–সংবলিত একাধিক বিলবোর্ড টাঙানো হয়েছে। গোসলে নামার আগে এই নির্দেশনা পড়ার অনুরোধ জানিয়ে সৈকতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু এদিকে নজর নেই অনেকের। সৈকতে গিয়েই সমুদ্রে গোসলে নেমে পড়েন অনেকে।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে সাগর উত্তাল। এ সময় সমুদ্রে গোসলে নামা খুবই বিপজ্জনক। তারপরও ভ্রমণে আসা কিছু লোক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করছেন এবং ঝুঁকি নিয়ে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে বিপদে পড়ছেন।
মো. মামুনুর রশীদ, জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার

জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে সাগর উত্তাল। এ সময় সমুদ্রে গোসলে নামা খুবই বিপজ্জনক। তারপরও ভ্রমণে আসা কিছু লোক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করছেন এবং ঝুঁকি নিয়ে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে বিপদে পড়ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক এবং কষ্টদায়ক। আনন্দ করতে এসে অসতর্কতার একটি গোসল কিংবা দুর্ঘটনা একটি পরিবারের জন্য সারা জীবনের কান্না, এটা কেউ অনুধাবন করতে চায় না। বিশেষ করে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের ঝুঁকি থেকে দূরে রাখতে ১০ দিনের বিশেষ এই ক্যাম্পেইন চালু করেছে জেলা প্রশাসন।

গোসলে নেমে কেউ যদি সমুদ্রে ভেসে যান, তাঁকে কীভাবে উদ্ধার করতে হবে, সমুদ্রে কখন নামতে হবে, কখন নামা নিষেধ, গোসলের সময় সঙ্গে কী কী জিনিস রাখা যায় বা রাখা যাবে না, নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে করণীয় কী—এসব নিয়েই এই ক্যাম্পেইন। ফায়ার সার্ভিসের সদস্য, ডুবুরি, লাইফগার্ডের কর্মী, ট্যুরিস্ট পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবার অভিজ্ঞতা বিনিময় হচ্ছে এই ক্যাম্পেইনে।

বৃষ্টিপাত কিংবা বৈরী পরিবেশে সৈকতে কয়েকটি পয়েন্টে একাধিক চোরাবালির গর্ত কিংবা গুপ্তখালের সৃষ্টি হয়। এসব পয়েন্টের আশপাশের সৈকতে গোসলে নামতে নিষেধ করে বালুচরে লাল নিশান ওড়ানো হয়। কিন্তু এসব তোয়াক্কা না করে পর্যটকদের কেউ কেউ গোসলে নেমে বিপদে পড়েন। গুপ্তখাল কিংবা চোরাবালির গর্তে আটকা পড়লে মুহূর্তে তাঁদের উদ্ধার করে আনাও কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, বৃষ্টিপাত কিংবা বৈরী পরিবেশে সৈকতে কয়েকটি পয়েন্টে একাধিক চোরাবালির গর্ত কিংবা গুপ্তখালের সৃষ্টি হয়। এসব পয়েন্টের আশপাশের সৈকতে গোসলে নামতে নিষেধ করে বালুচরে লাল নিশান ওড়ানো হয়। কিন্তু এসব তোয়াক্কা না করে পর্যটকদের কেউ কেউ গোসলে নেমে বিপদে পড়েন। গুপ্তখাল কিংবা চোরাবালির গর্তে আটকা পড়লে মুহূর্তে তাঁদের উদ্ধার করে আনাও কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

ট্যুরিস্ট পুলিশ ও লাইফগার্ডকর্মীদের দেওয়া তথ্যমতে, গত দুই মাসে পৃথক কয়েকটি দুর্ঘটনায় গুপ্তখালে আটকা পড়ে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচানো হয়েছে অন্তত ৫৫ জনকে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী।

লাইফগার্ডের দেওয়া তথ্যমতে, ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে সমুদ্রসৈকতের সি–গাল পয়েন্টে গোসলে নেমে মারা গেছেন তৌনিক মকবুল নামের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ঢাকার শ্যামলীর আদাবর এলাকার নুরুল আমিনের ছেলে।

২৬ জুন দুপুরে সৈকতের শৈবাল পয়েন্টে গোসলে নেমে মারা গেছে ইশরার হাসনাইন নামের কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী। জোয়ারের ধাক্কায় ভেসে যাওয়া এক সহপাঠীকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিখোঁজ হয় কক্সবাজার শহরের বাজারঘাটা এলাকার আমান উল্লাহর ছেলে ইশরার হাসনাইন। গুপ্তখালে আটকে থাকার কারণে ৭০ ঘণ্টা পর তার মরদেহ ভেসে আসে সৈকতে।

কক্সবাজার সৈকতে নিরাপদ গোসল নিয়ে সচেতনমূলক কর্মসূচি উপলক্ষে চলছে মহড়া। শুক্রবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

গোসলে নামার আগে ১০ নির্দেশনা

জেলা প্রশাসনের ১০ দফা নির্দেশনার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো সাঁতার না জানলে সমুদ্রের পানিতে নামার সময় অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরা, লাল নিশান চিহ্নিত পয়েন্টে (সৈকতে) কোনোভাবে গোসলে নামা যাবে না, সব সময় লাইফগার্ডের নির্দেশনা মেনে চলা, বিকেল পাঁচটার পর সমুদ্রে না নামা, সমুদ্রে নামার আগে জোয়ার-ভাটাসহ আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা জেনে নেওয়া, লাইফগার্ড যেখানে আছে তার বাইরের (যেখানে লাইফগার্ড নেই) সমুদ্রে গোসলে না নামা, যেকোনো ভাসমান বস্তু নিয়ে পানিতে নামার আগে বাতাসের গতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া, শিশুকে একা সমুদ্রে নামতে না দেওয়া, অসুস্থ অথবা দুর্বল শরীর নিয়ে সমুদ্রে হাঁটুপানির বেশি (গভীরে) না নামা।

১০ দিনব্যাপী চলা এই ক্যাম্পেইনে বিভিন্ন বিষয়ে ওপর বক্তব্য দেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), জাহিদ ইকবাল, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (মানবসম্পদ) নাসিম আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) বিভীষণ কান্তি দাশ, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) সৈয়দ মুরাদ প্রমুখ। এ ছাড়া ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন, ফায়ার সার্ভিস, ট্যুরিস্ট পুলিশ, লাইফগার্ডকর্মী, সার্ফারসহ পর্যটন ব্যবসা ও সেবায় সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিশেষ এই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।