‘কখন পানিত পড়ি যাই, সেই ভয়োত চৌকির ওপর নিন ধরে না’

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়া গ্রামের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে
ছবি: প্রথম আলো

দুই ছেলেকে নিয়ে রমিছা বেগমের (৫৩) চার সদস্যের সংসার। একসময় পাঁচ বিঘা জমি, বসতভিটাও ছিল। কয়েক বছরে নদীভাঙনে সবই শেষ। এখন অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকছেন। স্বামী দিনমজুর। কিন্তু বন্যায় হাতে কাজ নেই।

রমিছা বেগম বললেন, ‘বান আসি বিপোদোত পড়চি। খায়া না খায়া এ্যাকবেলা থাকান যায়। কিন্তু ঘরোত হাঁটুর সোমান পানি উটচে। কখন পানিত পড়ি যাই, সেই ভয়োত চৌকির ওপর নিন ধরে না। ঘরোত যেকন্যা খাবার আচিলো, তাক শ্যাষ হয়া গেচে। দুই দিন থাকি দেনা করি খাবার নাগচি। আর কাউয়ো ইলিপ দ্যায় নাই।’

রমিছা বেগমের বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়া গ্রামে। এবারের বন্যায় গোটা কুন্দেরপাড়া গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী খারজানি, পাটদিয়ারা, কড়াইবাড়ি গ্রামেরও একই অবস্থা। ব্রহ্মপুত্রের ওপারে অবস্থিত গ্রামগুলো উন্নয়নের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। কারণ, এগুলো ব্রহ্মপুত্রবেষ্টিত। নদীভাঙন তো আছেই।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে কামারজানি বাজার। সেখান থেকে নৌকাযোগে প্রায় এক ঘণ্টার পথ। তারপর কুন্দেরপাড়া গ্রাম। আজ সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমরপানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। বাড়ির উঠানে ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকায় খেলছে। অনেকে কলাগাছের ভেলায় বসে ত্রাণের অপেক্ষা করছে। কেউ চৌকির ওপর রান্নাবান্না করছেন।

গাইবান্ধা সদরের কুন্দেরপাড়া গ্রামের গৃহিণী আছিয়া বেগম (৫৫)। বাড়ির উঠানে ওঠা পানিতে দাঁড়িয়ে বলছিলেন বন্যায় কষ্টের কথা
ছবি: প্রথম আলো

কুন্দেরপাড়া গ্রামের গৃহিণী আছিয়া বেগমের (৫৫) চার সদস্যের সংসার। স্বামী ময়েজ উদ্দিনের দিনমজুরির উপার্জনে চলে সংসার। বসতভিটায় থাকা টিনশেড ঘরটির ভেতর হাঁটুপানি। পানিতে ডুবে থেকে ঘরের বেড়া, আসবাব নষ্ট হয়েছে।

আছিয়া বেগম নিজের ভাষায় বললেন, ‘হামরা ঘরে নদীর কাচে থাকি। নদীত পানি বাড়লে হামার ঘরে বাড়িঘর ডুবি যায়। এব্যারক্যা বানোত হামার ঘরে ম্যালা খতি হচে। বানোত সগ কিচু শ্যাস হয়া গেচে।’ তিনি বলেন, ‘সাত দিন থাকি পানিত আচি। ঘরোত খাবার নাই। চেরমেনের (চেয়ারম্যান) কাচে গেচিনো। ইলিপ পাই নাই। বেশি বিপোদে আচি মুরগি-ছাগল নিয়া।’

আরও পড়ুন

একই গ্রামের আজাহার আলী (৬০) বললেন, ‘বছরের বেশির ভাগ সমায় হামার ঘরে শানতি থাকে না। হাতোত কাম থাকলে হামার ঘরে কোনো অভাব হয় না। কিন্তু বানের সমায় হাতোত কাম নাই। সাত দিন থাকি পানিত ভাসচি। ইলিপ পাই নাই।’

কৃষক সোলায়মান হোসেনের (৪৫) চারটি ঘর ও একটি নলকূপ ডুবে গেছে। ডুবে যাওয়া নলকূপের পানি খারাপ হয়েছে। তাই নদীর পানি ফুটিয়ে পান করছেন। ফলে অনেকের পেটের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানান তিনি।

স্থানীয় উন্নয়নকর্মী সাদ্দাম হোসেন বলেন, বন্যার পানিতে তাঁদের পায়খানা, প্রসাবখানার ঘর ভেসে গেছে। ফলে পুরুষেরা কলার ভেলায় দূরে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সেরে নিলেও, নারীরা বিপদে পড়েছেন। বন্যার পানিও দূষিত হয়ে পড়েছে।

কামারজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান মুঠোফোনে বলেন, ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দী। আজ সোমবার নদীভাঙনের জন্য তার ইউনিয়নে ৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন, যা মঙ্গলবার মোট ৩৫০ জনের প্রত্যেককে ২০ কেজি করে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, তাঁর ইউনিয়নের লোকসংখ্যা প্রায় ২২ হাজার। এর মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ দরিদ্র। সে অনুপাতে তিনি ত্রাণ বরাদ্দ পান না।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শরীফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার নদীতীরবর্তী দুটি ইউনিয়ন কামারজানি ও মোল্লারচর বন্যাকবলিত। ইউনিয়ন দুটিতে মোট ১১ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে বন্যায় যেসব ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেগুলোতে বেশি ত্রাণ দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন