কনক পুকুরের গল্প

সিলেটের সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের কনক পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে কনকের কথা বলছিলেন প্রধান শিক্ষক বাবলী পুরকায়স্থ
ছবি: আনিস মাহমুদ

সময়টা ১৯৪০ সাল। অখণ্ড ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গের স্কুলগুলোর বেশির ভাগ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ওই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নেয়। ফলাফলে দেখা গেল, সবাইকে টপকে ম্যাট্রিকে প্রথম স্থান অধিকার করে নেন কনক পুরকায়স্থ নামের এক ছাত্রী। যঁার ডাকনাম ঊষা। এক ছাত্রীর প্রথম হওয়ায় চারদিকে হইচই পড়ে যায়। কিন্তু এরপরেই উধাও কনক। কনক প্রসঙ্গে কলকাতার প্রখ্যাত লেখক নারায়ণ সান্যাল লিখেছেন, ‘গোটা বাংলাকে চমকে দিয়েছিল যে মেয়েটি, হঠাৎই সে হারিয়ে গেল। যেসব ছেলে কনককে পরীক্ষার ফলাফলে হারাবার জন্য তাল ঠুকছিল, পরের পরীক্ষায় প্রথম দশজনের মধ্যে কনককে না দেখে তারা হতবাক। কোথাও কনকের নাম নেই। কোথায় গেল প্রতিভাময়ী মেয়েটি?’

কনক পুরকায়স্থ সিলেটের মেয়ে। সিলেট গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলের (বর্তমানে সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ) ছাত্রী ছিলেন তিনি। কনকের সম্পর্কে জানতে গিয়ে তাঁর বিদ্যাপীঠ সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক বাবলী পুরকায়স্থের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, ম্যাট্রিক পাস করে কনক কলকাতার মেট্রোপলিটান কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হন। তবে আইএসসি পরীক্ষার আগে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। ‘সিক বেডে’ শুয়ে আইএসসি (উচ্চমাধ্যমিক) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কোনোরকমে পাস করেছিলেন তিনি। আইএসসির ফল প্রকাশের কিছু পরে ১৯৪৩ সালের ২৪ মার্চ অকালেই মারা যান কনক।

বাবলী পুরকায়স্থ বলেন, কনক ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় যেসব ছাত্রকে পেছনে ফেলে প্রথম হয়েছিলেন, এঁদের মধ্যে নারায়ণ সান্যালও ছিলেন। সেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ছয় দশক পর নারায়ণ সান্যাল ভারত থেকে বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন তাঁর অদেখা-অজানা সহপাঠিনী কনকের সন্ধানে। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে তিনি কনকের জীবনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লিখেছেন কনকলতার সন্ধানে নামের একটি জীবনকাহিনিভিত্তিক উপন্যাস। যেটি পরে ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়।

কলকাতার সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত ‘সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান’ প্রথম খণ্ডেও কনকের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সাফল্যগাথা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রয়াত নারীনেত্রী ও কনকের সহপাঠিনী হেনা দাস তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ স্মৃতিময় দিনগুলোতে জানিয়েছেন, তাঁর কর্মী দলে মেধাবী ছাত্রী কনককে তিনি পেয়েছিলেন।

জানা গেল, কনকের বাবা ছিলেন আইনজীবী দীনেশ চন্দ্র পুরকায়স্থ, মা বনলতা পুরকায়স্থ। তাঁরা থাকতেন সিলেট শহরের সোবহানীঘাট এলাকায়। ১০ ভাই-বোনের মধ্যে কনক ছিলেন চতুর্থ। কনক ম্যাট্রিকে প্রথম স্থান পাওয়ার পর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। সেখানে সভাপতিত্ব করেছিলেন স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ও অবৈতনিক প্রধান শিক্ষিকা হেমন্তকুমারী চৌধুরানী। কনকের প্রয়াণের পর তাঁর স্মরণে এক শোকসভাও হয়। সে সভায় স্কুলে কনকের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের প্রস্তাব আসে। তবে এতে আপত্তি জানিয়ে হেমন্তকুমারী চৌধুরানী বলেছিলেন, কনক আড়ম্বর পছন্দ করতেন না। তাই ভাস্কর্য স্থাপনের বদলে স্কুলের পুকুরটির নামকরণ করা যেতে পারে। সেই থেকেই বিদ্যালয়টির কৃতী ছাত্রীর স্মৃতি ধরে আছে ‘কনক পুকুর’।