করোনা চিকিৎসায় ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ কক্সবাজার সদর হাসপাতাল
করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২১ এপ্রিল কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হন শহরের নন্দনকানন এলাকার বাসিন্দা রোতাব চৌধুরী। দুই দিন পর একই ইউনিটে ভর্তি হন তাঁর স্ত্রী রুবি চৌধুরী ও কলেজপড়ুয়া মেয়ে ঋদিতা চৌধুরী। তাঁদেরও করোনা শনাক্ত হয়। টানা ১৯ দিন হাসপাতালে থেকে করোনামুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন এক পরিবারের এই তিন সদস্য।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের আলোকচিত্রী রোতাব চৌধুরী (৫৩) প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও তাঁর নমুনায় করোনা পজিটিভ হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সের আন্তরিক সহযোগিতায় তাঁরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। তিনি বলেন, এ হাসপাতালে এক বছর আগেও করোনা রোগীর চিকিৎসার এত উন্নত ব্যবস্থা ছিল না। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চট্টগ্রাম-ঢাকায় নিয়ে যেতে হতো, যাঁদের সামর্থ্য থাকে না, তাঁদের অন্য রকম পরিণতি হজম করতে হতো।
করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হতো কক্সবাজারের মানুষকে। সংকটাপন্ন রোগী নিয়ে টানাটানি চলত চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায়। কারণ, তখন কক্সবাজারের কোথাও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ছিল না। ছিল না করোনা রোগীর চিকিৎসায় বিশেষ সুবিধাসংবলিত আইসোলেশন সেন্টার। তবে এক বছরের ব্যবধানে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। ২৫০ শয্যার সরকারি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে একসঙ্গে ১১৯ জন করোনা রোগীর চিকিৎসা চালানোর ব্যবস্থা আছে, যা দেশের অনেক জেলা শহরেই নেই।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারের পাশাপাশি জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাসহ (আইওএম) বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তিবিশেষের আর্থিক সহযোগিতায় হাসপাতালে পৃথক চারটি করোনা ইউনিটে অক্সিজেন, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা, মেডিক্যাশন, আধুনিক সব যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে।
হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) এস এম নওশাদ রিয়াদ প্রথম আলোকে জানালেন, করোনা রোগীর চিকিৎসায় এই সরকারি হাসপাতাল এখন ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলা যায়। এখন চট্টগ্রামের সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসার জন্য এখানে পাঠানো হচ্ছে, যা আগে ছিল না।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, করোনা শুরুর পর থেকে গত মে পর্যন্ত ১৪ মাসে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ১৫৩ জন করোনা রোগী। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন ৩৭ জন। বাকি ১ হাজার ১১৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এর মধ্যে ২০২০ সালের ৯ মাসে (এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬৬৩ জন। মারা গেছেন ২৫ জন। অন্যদিকে চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে পযন্ত ৫ মাসে ভর্তি হন ৪৯০ জন করোনা রোগী। মারা গেছেন ১৯ জন।
হাসপাতালের চারটি পৃথক ইউনিটে করোনা রোগীর চিকিৎসায় শয্যা (বেড) আছে ১১৯টি। গত বৃহস্পতিবার (১০ জুন) এসব ইউনিটে ভর্তি ছিলেন ৮৬ জন রোগী। এর মধ্যে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটে ভর্তি ছিলেন ৯ জন, ৮ শয্যার এইচডিইউ ইউনিটে ভর্তি ছিলেন ৭ জন, ২০ শয্যার করোনা ইউনিটে ভর্তি ৯ জন, ৪৩ বেডের রেড জোন ইউনিটে ৩০ জন এবং ৩৮ বেডের ইয়েলো জোনে ৩১ জন রোগী। ৪১ জন চিকিৎসক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।
গত এপ্রিল থেকে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসক আফরিনা এহসান ছন্দা। তিনি বলেন, হাসপাতালে যখন রোগীর চাপ বেড়ে যায়, তখন চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রোগীদের পেছনে পড়ে থাকতে হয়। তবে সংকটাপন্ন রোগীদের পাশে থাকতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে হয়। তিনি জানান, সেবা দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত করোনা ইউনিটের কোনো চিকিৎসক-নার্স করোনায় আক্রান্ত হননি, সবাই করোনার টিকাও নিয়েছেন।
করোনা নিয়ে গত ১৮ মে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মোহাম্মদ হোসেন (৫৮)। তিনি ১১ দিন পরই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। হাসপাতালের সেবা নিয়ে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, এই ১১ দিন তিনি হাসপাতালে অবহেলার শিকার হননি। চিকিৎসক-নার্সেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের মানবিক সেবা দিচ্ছেন।
হাসপাতালে সেবা নেওয়া আরেক করোনা রোগী শহরতলির সাবমেরিন কেবল এলাকার বাসিন্দা লয়েন চাকমা (৪৩) বলেন, করোনা রোগীর চিকিৎসায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বলেই সংকটাপন্ন রোগীদের বাঁচার আস্থা বেড়েছে অনেক। তিনিও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২১ মে। করোনাকে জয় করে তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন ৩০ মে।
এ হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় আধুনিক সব সক্ষমতা আছে, যা দেশের অন্যান্য জেলায় নেই। বর্তমানে এ জেলায় (কক্সবাজারে) সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১ হাজারের বেশি করোনা রোগীর চিকিৎসায় ১২টির বেশি আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত আছে
হাসপাতালের ল্যাব সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩ জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। আগের দিন বুধবার ১০৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে পজিটিভ পাওয়া যায় ১৫ জনের।
হাসপাতালের আরএমও এস এম নওশাদ রিয়াদ বলেন, প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী আসেন ৮০০ থেকে ৯০০ জন। এর মধ্যে অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ জন আসেন করোনার উপসর্গ নিয়ে। প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সদর হাসপাতালের আইসিইউ এবং এইচডিইউ ইউনিট দুটি স্থাপন করে দেয় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। আর করোনার রেড জোন ও ইয়েলো জোন ইউনিট তৈরি করে দেয় আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি আইসিআরসি। সরকারিভাবে তৈরি হয়েছে ২০ শয্যার পৃথক আরেকটি করোনা ইউনিট।
ইউনিটগুলোতে অক্সিজেন, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা, অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ দিয়েছে শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সেব) , কক্সবাজার পৌরসভা, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষ। করোনা ইউনিটে কর্মরত ৩০ জনের বেশি চিকিৎসকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ ও সাবেক জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন দিয়েছেন সার্বিক সহযোগিতা।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় আধুনিক সব সক্ষমতা আছে, যা দেশের অন্যান্য জেলায় নেই। বর্তমানে এ জেলায় (কক্সবাজারে) সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১ হাজারের বেশি করোনা রোগীর চিকিৎসায় ১২টির বেশি আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত আছে। আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে ভর্তি আছেন ৩৫৭ জন করোনা রোগী।