কলমাকান্দার ৮৫ বছরের বৃদ্ধ বললেন, ‘এমন বন্যা কখনো দেখিনি’

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় এখন শুধু পানি আর পানি
ছবি: প্রথম আলো

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এক রাতে এত পানি বাড়তে আগে কেউ কখনো দেখেননি এখানকার লোকজন। সন্ধ্যায় যে সড়ক শুকনা ছিল, সকালে সেখানে কোমর পানি। যে ঘরে রাতে ঘুমিয়েছেন, সকালে সেখানে হাঁটু পানি।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, এমন দুর্বিষহ অবস্থা ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ও হয়নি। বন্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। অব্যাহত ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে এই উপজেলার ৯২ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। শুধু কলমাকান্দা-ঠাকুরাকোনা সড়ক, কলমাকান্দা-দুর্গাপুর সড়কের আংশিক, কলমাকান্দা-পাঁচগাঁও সড়কের আংশিক অংশসহ বিভিন্ন এলাকার কিছু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং বহুতল ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি আর পানি। আগামী এক দিনে এই পানি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

নেত্রকোনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহনলাল সৈকত আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ অনুযায়ী নেত্রকোনায় পানি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে জেলার কংস, সোমেশ্বরী, উব্দাখালী, ধনুসহ বেশকিছু নদ–নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও উব্দাখালী নদীর কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৬ দশমিক ৫৫ মিটার। কংস নদের জারিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি যাচ্ছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৯ দশমিক ৭৫ মিটার। গতকাল শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত কলমাকান্দায় ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় বলে জানান তিনি। আজ সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত মোহনগঞ্জে ৭৫ মিলিমিটার এবং দুর্গাপুরের জারিয়া পয়েন্টে ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।

কলমাকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক বলেন, ‘আমার ৭৭ বছরের জীবনে কলমাকান্দায় এক রাতে এমন ভয়াবহ বন্যা হতে কখনো দেখিনি। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ৩৪৩টি গ্রামের মানুষই পানিবন্দী। ৩৭৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের উপজেলাটির প্রায় ৯২ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। আগে বন্যা হলে দ্রুত পানি নেমে যেত, এখন এই পানি নামার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। নদ-নদীগুলো বৃষ্টির পানির ঢল ধরে রাখতে পারছে না।’

পাউবো সূত্র জানায়, জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, মদন, মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা, সদর উপজেলার আংশিক অংশ ও খালিয়াজুরি উপজেলার বন্যার পানি কমতে আগামী দুই দিনের মতো সময় লাগতে পারে। অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। বন্যার পানি খালিয়াজুরি উপজেলার হাওরগুলো দিয়ে ধনু নদ হয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা মিঠামইন হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে নামবে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টার পর থেকে কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, মোহনগঞ্জ, বারহাট্টাসহ ছয়টি উপজেলায় বন্যার পানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। উপজেলার প্রায় সব এলাকায় এখন বন্যার পানি থই থই করছে। পানিবন্দী হয়ে পড়ছে প্রায় সাত লাখ মানুষ। উপজেলার সঙ্গে ইউনিয়নগুলোর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কলমাকান্দার সঙ্গে জেলার সড়কপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ছয়টি উপজেলায় ১৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। গোবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। অনেক এলাকায় সড়কের উঁচু স্থানে তাবু টানিয়ে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন। সেখানে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি রাখা হচ্ছে। খাবারের পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় আরও বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে মানুষকে।

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাদুর্গত এলাকায় এরই মধ্যে ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৬০ মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

সরেজমিনে কলমাকান্দা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, ঘরে পানি আসায় খাটে মানুষ শুকনো ধান, গৃহপালিত প্রাণিসহ একসঙ্গে গাদাগাদি করে আছে। রান্নার চুলায় পানি আসায় শুকনো খাবার খেয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেকের শুকনো ধান, চালসহ ঘরের আসবাপত্র সব কিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকেই বাসাবাড়ি ছেড়ে আত্মীয় বাড়ি ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। আবার অনেকে বাহনের অভাবে আশ্রয়কেন্দ্রেও যেতে পারছে না।

কলমাকান্দার আশারানী সেতুসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা রইছ মিয়া আজ সকালে বলেন, ‘দুটি শিশু সন্তান নিয়ে গতকাল সকাল থেকে শুকনা খাবার খেয়ে আছি। সব কিছু ডুবে গেছে। ঘরের ৮০ মন শুকনা ধান পানির নিচে। এখন সড়কে ঠাঁই নিয়েছি।’ পাগলা গ্রামের বাসিন্দা রতি বিশ্বাস (৮৫) বলেন, ‘আমার এত বছর বয়সে এমন বন্যা আর কখনো দেখিনি।’