কাঞ্চনমোড়ে ৩১ বছর ধরে মুড়িমাখা বিক্রি করছেন গোলাপ
বস্তার ভেতর থেকে মুচমুচে মুড়ি নিয়ে ঢালছেন বালতিতে। এরপর মেশানো হচ্ছে পরিমাণমতো মরিচ-পেঁয়াজকুচি। চামচে করে পাতিল থেকে তোলা হচ্ছে ‘ম্যাজিক’ মসলা। বোতলে চাপ দিতেই বালতিতে পড়ছে মসলার তেল। ছোট আকৃতির লাঠি দিয়ে মাখানো শেষ হতে না হতেই বিক্রেতার দিকে জনাদশেকের হাত এগিয়ে আসে। ‘ভাই এখানে ১০ টাকার, ভাই এখানে দেন ২০ টাকার।’ এভাবে সময় পার হয়, শূন্য হয় মুড়ির বস্তা, ভরে ওঠে গোলাম মোস্তফা ওরফে গোলাপের (৫০) পকেট।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার কাঞ্চনমোড় এলাকায় গোলাম মোস্তফার মুড়িমাখার দোকান। এই মোড়ে টানা ৩১ বছর ধরে মুড়িমাখা বিক্রি করছেন তিনি। সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে তেঘড়া এলাকায় তাঁর বাড়ি। নাম গোলাম মোস্তফা হলেও ‘ঝালমুড়ি গোলাপ’ নামে পরিচিত তিনি। তাঁর হাতে বানানো মুড়িমাখা খেতে প্রতিদিন ভিড় করেন বহু লোক। ছুটির দিনে ভিড় থাকে দ্বিগুণ। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দোকানের সামনে ভ্যানগাড়িতে বসে মুড়িমাখা বিক্রি করেন তিনি।
দিনাজপুর শহর ও বিরলসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকেও গোলাম মোস্তফার মুড়িমাখা খেতে আসেন অনেকে। তাঁর তৈরি ‘ম্যাজিক মসলা’র সুগন্ধ মন কেড়েছে অনেকের। অনেকেই রুটি কিংবা ভাতের সঙ্গে খাওয়ার জন্য তাঁর কাছ থেকে ম্যাজিক মসলা কেনেন।
‘ম্যাজিক মসলা’র রেসিপি বলতে চান না গোলাম মোস্তফা। তাঁর ধারণা, এতে রহস্য উন্মোচন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, তাঁর তৈরি এ মসলায় আদা, রসুন, হলুদ, এলাচ, কালিজিরা, শর্ষে, জিরা, লবঙ্গ, জয়ত্রী, জায়ফল, মেথি, সয়াবিন তেলসহ ২২ রকমের উপাদান ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন এক মণ মসলা তৈরি করেন তিনি। এর মধ্যে মুড়িমাখায় যায় ২২ থেকে ২৫ কেজি। বাকিটা আলাদাভাবে বিক্রি করেন।
শনিবার বিকেলে গোলাম মোস্তফার দোকানে গিয়ে দেখা যায়, জনবিশেক কিশোর মুড়িমাখা খাচ্ছে। তাদেরই একজন সাজিদ হোসেন (১৪) প্রথম আলোকে বলে, এখানকার মুড়ি খুবই মজার। প্রায় প্রতিদিনই কোচিং থেকে ফেরার পথে এখানে মুড়িমাখা খায় সে।
ভ্যানগাড়িতে ছোট ছোট পলিথিনে ‘ম্যাজিক মসলা’ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাকিবুল ইসলাম নামে একজন, পাঁচ পোঁটলা মসলা কেনেন। তিনি বলেন, বগুড়া শহরে বাড়ি তাঁর। বিরলে শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন। মুঠোফোনে বউ বারবার মনে করে দিয়েছেন গোলাপের মসলা নিয়ে আসার কথা।
৩১ বছর ধরে মুড়িমাখা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন গোলাম মোস্তফা। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলেমেয়েরা সবাই পড়ালেখা করে। নিজের টিনশেড বাড়ি–লাগোয়া তিনতলা ভিত্তির একটি ভবন তুলেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই দ্বিতীয়তলার ছাদের কাজ শেষ হয়েছে। তাঁর স্ত্রী কবুতর, হাঁস, মুরগির পাশাপাশি গরু-ছাগলও পালন করেন।
রোববার সকালে উপজেলার তেঘড়া এলাকায় গোলাম মোস্তফার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে মসলা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। তিনি জানান, ১৯ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন স্কুলের ফটকে ঝালমুড়ি বিক্রি শুরু করেন। সকালে স্কুলে আর বিকেলে কাঞ্চনমোড় এলাকায়। দৈনিক গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার মুড়িমাখা ও ম্যাজিক মসলা বিক্রি হয় তাঁর। ৮০০ টাকা বেতনে দোকানে দুজন কর্মচারীও রেখেছেন। সব খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক লাভ থাকে প্রায় ২ হাজার টাকা। তবে তেল-মসলাসহ সব পণ্যের দাম বাড়ে যাওয়ায় লাভের পরিমাণ কিছুটা কমেছে।
গোলাম মোস্তফার এই ব্যবসায় আসার পেছনের গল্পটা বেশ দারুণ। গল্পটা স্ত্রী মনোয়ারারও জানা। তবু গলা নামিয়ে বলতে শুরু করেন তিনি। তাঁর বয়স যখন ১৯, তখন চাচাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি মুন্সিগঞ্জে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সাত মাস থাকার পর সেখানে এক মেয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়। প্রেমিকার বাবা ছিলেন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। ম্যাজিক মসলার রেসিপি তাঁর আবিষ্কার। তাঁর কাছ থেকে রেসিপি শেখেন গোলাম মোস্তফা। একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে প্রেমিকার সঙ্গে আংটি বদলও হয়। কিন্তু দিনকয়েক পরেই মত বদলান প্রেমিকার বাবা। আংটি ফেরত নিতে হয় গোলাম মোস্তফাকে। পরদিন মুন্সিগঞ্জ থেকে ফিরে আসেন দিনাজপুরে নিজের গ্রামে। ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রেমিকার বাবার কাছ থেকে শেখা রেসিপি দিয়ে ঝালমুড়ির ব্যবসা শুরু করেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁর।