কারাগার থেকে জানাজায় এসে বাবা বললেন, ‘আমি ক্যামনে সংসার চালামু’
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ফায়ার সার্ভিসের কর্মী রমজানুল ইসলাম ওরফে রনির (২২) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় শেরপুরের সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের হেরুয়া বালুরঘাট গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
এর আগে হেরুয়া বালুরঘাট গ্রামের বাড়িতে রমজানুলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় শেরপুর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা রমজানুলের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এ সময় তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। জানাজায় রমজানুলের বন্ধু-স্বজনসহ সহস্রাধিক লোক অংশ নেন।
কারাগার থেকে জামিনে এসে ছেলের জানায় অংশ নিয়েছেন আকরাম হোসেন। জানাজার আগে তিনি বলেন, ‘অনেক শখ ছিল আমার বড় ছেলে রনি ডিফেন্সে চাকরি করবে। চাকরিও পাইছিল। কিন্তু দুর্ঘটনায় সব তছনছ হইয়া গেল। আমি অসুস্থ, মিথ্যা মামলায় জেল খাটতাছি। এহন আমি ক্যামনে সংসার চালামু। তাই সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আমার ছোট ছেলে তারিকুল ইসলামরে যেন একটা চাকরি দেয়।’
নিহত রমজানুল ইসলাম সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনে ফায়ার ফাইটার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আগুন নেভাতে গিয়ে তিনি মারা যান।
আজ মঙ্গলবার সকাল সাতটার দিকে হেরুয়া বালুরঘাট গ্রামের বাড়িতে রমজানুলের মরদেহ এসে পৌঁছায়। এ সময় স্বজন ও এলাকাবাসীকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। তাঁরা চোখের জলে রমজানুলকে শেষবিদায় জানান।
রমজানুলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে গত রোববার রাতে তাঁর মা কামরুন্নাহার বেগম, চাচা আবুল কাশেম ও ছোট ভাই তারিকুল ইসলাম লাশ নিতে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন। রমজানুলের স্ত্রী রূপা আক্তার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই অবস্থান করছিলেন। সোমবার সন্ধ্যায় রমজানুলের লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে শেরপুরের উদ্দেশে রওনা দেন তাঁরা। লাশ নিয়ে মঙ্গলবার সকালে বাড়িতে এসে পৌঁছান তাঁরা।
নিহত রমজানুলের বাবা আকরাম হোসেন সদর থানার একটি হত্যা মামলার আসামি। তিন মাস ধরে তিনি জেলা কারাগারে বন্দী। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শেরপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর সবুর তাঁকে সাত দিনের জন্য জামিন দেন। মুক্তি পেয়ে গতকাল সোমবার বিকেলে বাড়িতে আসেন। আজ মঙ্গলবার ছেলের জানাজায় অংশ নেন আকরাম।
রমজানুলের ৭০ বছর বয়সী দাদা ইউনুস আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রনির টাকায় সংসার চলত। ছোট নাতি-নাতিনদের পড়ালেখাসহ সব খরচ দিত সে। সেই রনি এখন আর নাই। আগুনে পুইড়া ক্ষতবিক্ষত হইয়া মারা গেছে। আমার ছেলে আকরাম মিথ্যা মামলায় জেল খাটতাছে। পরিবারের কোনো আয়-রোজগার নাই। তাইলে সংসার চলব ক্যামনে?’
সাত-আট মাস আগে রনির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। আমরা সুখে সংসার করছিলাম। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন সইল না। অকালে স্বামীকে হারালাম। আমার তো কোনো সন্তানও নাই। তাহলে আমি কী নিয়ে বাঁচব?
রমজানুলের স্ত্রী রূপা আক্তার বলেন, ‘আমি কৃষি ডিপ্লোমা পাস। মাত্র সাত-আট মাস আগে রনির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। আমরা সুখে সংসার করছিলাম। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন সইল না। অকালে স্বামীকে হারালাম। আমার তো কোনো সন্তানও নাই। তাহলে আমি কী নিয়ে বাঁচব? তাই আমার বাঁচার জন্য যোগ্যতা অনুসারে সরকারের কাছে একটা চাকরির আবেদন জানাই।’
রমজানুলের পরিবার সূত্রে জানা যায়, দেড় বছর আগে ফায়ার ফাইটার হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের চাকরিতে যোগ দেন রমজানুল। তিন মাস আগে তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনে বদলি হন। সাত-আট মাস আগে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রী রূপা আক্তারকে নিয়ে সীতাকুণ্ডে থাকতেন। রমজানুলেরা দুই ভাই ও দুই বোন। তিনি সবার বড়। ছোট ভাই তারিকুল ইসলাম চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা পাস করে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করছেন। রমজানুলের ছোট বোন আশামণি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে নবম ও আঁখিমণি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।
সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন রমজানুল। বছরে এক-দুইবার বাড়িতে এলে তিনি প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নিতেন ও শিশু-কিশোরদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন। তাঁর আয়েই পরিবারটি চলত। এ অবস্থায় তিনি রমজানুলের অসহায় পরিবারকে প্রয়োজনীয় অর্থসহায়তা দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স শেরপুরের উপপরিচালক মো. জাবেদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি দায়িত্ব পালনকালে ফায়ার ফাইটার রমজানুল নিহত হয়েছেন। তাঁর লাশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। তাঁর পরিবারকে অর্থসহায়তাসহ সরকারি নিয়মানুযায়ী সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।