‘কালো চালের ধান, জীবনে এই প্রথম দেখলাম’
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত। মাঝখানে একচিলতে জমিতে সবুজের মাঝে কালচে ছোপ ছোপ। এটাও ধানখেত। গান গাইতে গাইতে ওই খেতে ধান কেটে চলেছেন কয়েকজন শ্রমিক। খেতের দিকে নজর যেতেই থমকে দাঁড়ালেন শহিদুল ইসলাম (৭২)। এগিয়ে এসে ধানের ছড়া তুলে নিলেন হাতে। নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না। শুধুই চেয়ে দেখলেন। ঘোর কাটতেই কয়েকটি ধানের আবরণ ছাড়িয়ে বের করে আনলেন চাল। মনের অজান্তেই বলে উঠলেন, ‘কালো চালের ধান! জীবনে এই প্রথম দেখলাম।’
ঠাকুরগাঁওয়ে এবারই প্রথমবারের মতো ‘ব্ল্যাক রাইস’ বা ‘কালো চালের ধান’ চাষ হচ্ছে। ২ নভেম্বর এই জাতের ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার জওগাঁও, বনগাঁও, বলিদ্বারা ও ধর্মগড় গ্রামের আট কৃষক এক বিঘা করে চলতি আমন মৌসুমে এই ধানের আবাদ করেছেন।
কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, দেশে প্রথম কালো চালের ধানের আবাদ শুরু হয় কুমিল্লায়। এই ধান সৌন্দর্য ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। এই ধানগাছের পাতা ও কাণ্ডের রং সবুজ হলেও ধান ও চালের রং কালো। তাই এ ধানের জাতটি কালো চালের ধান নামে পরিচিত।
সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জওগাঁও গ্রামে আলমগীর হোসেনের খেতে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে সবুজ ধানখেতের মাঝখানে কালো রঙের ধানের আবাদ। গানের সুরে সুরে শ্রমিকেরা সেই ধান কেটে চলছেন। ধান কাটতে ব্যস্ত মঙ্গল রায় বললেন, ‘হামাতো অনেক দিন ধরে ধান কাটে বেরাও। ধান কাটবা আসে দেখনু, ধানলা কালাকালা করচে। ধান থাকিয়া চাল বার করিয়া দেখনু, চালটাও কালো।’
এই ধান একপলক দেখতে ততক্ষণে ভিড় করেছেন গ্রামের অনেক মানুষ। তাঁরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। নেড়েচেড়ে দেখার পর অনেকেই ধানটা কোন দেশের? চাষপদ্ধতি কী? ফসল তুলতে কত দিন সময় লাগে? চাল কোথায় বিক্রি হয়? রান্নার পর ভাতের কী রং হয়? খুঁটে খুঁটে এমন সব প্রশ্নের জবাব বের করার চেষ্টা করতে থাকেন তাঁরা। তাঁদের একজন শহিদুল। ফেরার সময় শহিদুল এক কেজি ধানের বীজ রেখে দিতে আলমগীরকে অনুরোধ করে যান।
সে সময় খেতে এসে উপস্থিত হন রানীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জমিরুল ইসলাম। তিনি বেশ কিছু সময় ধরে ধানের শিষগুলো নেড়েচেড়ে দেখেন। এরপর বললেন, ‘এলাকায় এই ধান একেবারেই নতুন। শুনেছি, পুষ্টিগুণও ভালো। নিজেও ধানটি আবাদ করার কথা ভাবছি।’
কৃষক আলমগীর হোসেন জানালেন, তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। গত জানুয়ারি মাসে এলপিআরে (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি) যান। বাড়িতে ফিরেই কৃষিকাজে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। রানীশংকৈল কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করলে তাঁরা আলমগীরকে ‘ব্ল্যাক রাইস’ আবাদের পরামর্শ দেন। একপ্রকার কৌতূহল থেকে তিনি আবাদ শুরু করেন।
আলমগীর বলেন, ‘ফলন কেমন হয়, কৌতূহল থেকে তা দেখার জন্য কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে এক বিঘা জমিতে ব্ল্যাক রাইস ধানের চারা রোপণ করি। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে সাত হাজার টাকা। ধান মিলেছে ১৭ মণ। ব্ল্যাক রাইস চাষাবাদ অন্যান্য আধুনিক ধান চাষের মতোই। এতে কোনো অতিরিক্ত সার বা পানির প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় না আলাদা কোনো পরিচর্যার।’
রানীশংকৈলের বনগ্রাম গ্রামের কৃষক পয়গাম আলীও শখের বশে এক বিঘা জমিতে ব্ল্যাক রাইস আবাদ করছেন। তিনি বলেন, ‘এটা নতুন ধান। পরীক্ষামূলকভাবে এক বিঘা জমিতে কালো রঙের ধানের চাষ করেছি। ভালো ফল পেলে আরও বড় করে আবাদ করার কথা ভাবছি।’
কৃষি বিভাগ জানায়, এই চালের খাদ্যগুণ অনেক। রয়েছে ঔষধিগুণও। ১১টি অ্যামিনো অ্যাসিড আছে এতে। কপার, জিংক, ফাইবারের মাত্রাও বেশ। কার্বোহাইড্রেড অন্তত কম বলে ডায়াবেটিসের রোগীরাও তা খেতে পারেন। তা ছাড়া সাদা চাল বা পরিশোধিত ময়দার তুলনায় এটি স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে বেশি কার্যকর।
রানীশংকৈল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, চিকিৎসাসংক্রান্ত গুণাগুণের জন্য ব্ল্যাক রাইসের চালকে ‘ওয়ার্ল্ড সুপার ফুড’ বলা হয়। তাই এর দামও অন্য সব চালের তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্বের ধনী দেশগুলোতে এই চালের ব্যাপক চাহিদা। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে কালো চালের বাজার আছে। ব্ল্যাক রাইসের এই জাত কুমিল্লার কৃষক মঞ্জুর হোসেনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা। উপজেলার আটজন কৃষক আট বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে এই ধানের আবাদ করছেন। উৎপাদিত এই ধানের সবটুকুই বীজের জন্য রেখে দেওয়া হবে। দামি এই চালের ধান রোপণ করে কৃষকেরাও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবেন বলে মনে করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক (ডিডি) আবু হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে কালো চালের ধানের চাষ হলেও এই জেলায় এটা প্রথম। এই ধান চাষে কৃষকেরা কতটা লাভবান হবেন, ফলন কী রকম হয়, সেসব বিষয় পরীক্ষা করে পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।