রূপগঞ্জে জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিক পাখিমা আক্তার, জাহানারা ও নাঈম। তাঁদের তিনজনের বাড়িই কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের মথুরাপাড়া গ্রামে
ছবি: সংগৃহীত

রূপগঞ্জে জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজ শ্রমিকদের অন্তত ১৮ জনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায়। নিখোঁজ এসব শ্রমিকের বাড়িতে তিন দিন ধরেই চলছে মাতম। তাঁদের আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারী এখন জেলার চারটি উপজেলার অন্তত ১৫টি গ্রাম। স্বজনদের অনেকেই আগুনে অঙ্গার হয়ে যাওয়া প্রিয়জনের মরদেহ খুঁজে না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরেছেন বাড়ি। কেউ কেউ ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা দিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন লাশের আশায়।

গত বৃহস্পতিবার ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের উত্তর কান্দাইল গ্রামের মিনা আক্তারের (৩৩) লাশ পাওয়া যায় ইউএস–বাংলা মেডিকেল কলেজ। স্বামী হারুন মিয়া স্ত্রীর লাশ নিয়ে ওই দিন গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন। মিনা আক্তারের এমন মৃত্যুতে এখনো শোকে মুহ্যমান গোটা পরিবার। মিনা আক্তারের স্বজনেরা অন্তত মরদেহটি বুঝে পেয়েছেন। কিন্তু জেলার নিখোঁজ বাকি শ্রমিকদের পরিবারের লোকজন অন্তত তাঁদের প্রিয়জনের লাশ দাফনের সুযোগটুকু চাইছেন। এখন শুধু চোখের জলই তাঁদের একমাত্র সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের লোকজন অন্তত তাঁদের প্রিয়জনের লাশ দাফনের সুযোগটুকু চাইছেন। এখন শুধু চোখের জলই তাঁদের একমাত্র সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজ শনিবার বিকেল পর্যন্ত সরেজমিন জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের মথুরাপাড়া, সদরের দানাপাটুলী ইউনিয়নের কালিয়ারকান্দা, যশোদল ইউনিয়নের ব্রাহ্মণকান্দি, বৌলাই ইউনিয়নের রঘুনন্দনপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে এমনই চিত্র দেখা গেছে।

মথুরাপাড়ার নিখোঁজ পাখিমা আক্তারের বাড়িতে দেখা যায়, স্বামী আব্দুল কাইয়ুম শয্যাশায়ী। মেয়ে স্থানীয় মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্রী আছমা ও ছোট ছেলে জুয়েল কাঁদছে। স্বজনেরা জানান, চার বছর ধরে ওই কারখানায় কাজ করতেন পাখিমা এবং তাঁর বড় ছেলে মোস্তাকিম। রাতের পালায় ডিউটি থাকায় ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যায় মোস্তাকিম। টানা দুই দিন ঘটনাস্থল এবং হাসপাতালে ছোটাছুটি করেও মায়ের লাশ পাননি মোস্তাকিম।

নিহত জাহানারার দুই সন্তানের আহাজারি। শনিবার বিকেলে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের মথুরাপাড়া গ্রামে
প্রথম আলো

পাশের বাড়ির জাহানারাও পাখিমার সঙ্গে একই ফ্লোরে কাজ করতেন। জাহানারার স্বামী খোকন মিয়া, তাঁর দুই ছেলে জাকির ও রাকিবুল অনেক খুঁজেও মায়ের লাশ পাননি। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা দিয়ে গতকাল শুক্রবার রাতে তাঁরা বাড়ি ফেরেন। জাহানারার শোকে বাবা ধনু মিয়া এখন বাক্‌রুদ্ধ। মেয়ের লাশ আর পাবেন কি না জানা নেই তাঁর।

অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিখোঁজ হয়েছে একই গ্রামের তাহের উদ্দিনের একমাত্র ছেলে নাঈম (১৮)। তাহের উদ্দিনের বাড়িতে এখন মাতম। নাঈমের বড় বোন রোজিনা আক্তার বলেন, ছয় মাস ধরে তাঁর ভাই ওই কারখানায় কাজ করেছেন। পরিবারের লোকজন ঢাকায় গিয়ে ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে রাত–দিন খুঁজেও লাশ পাননি।

এদিকে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, জেলার বিভিন্ন এলাকার নিখোঁজ শ্রমিকের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। নিখোঁজদের মধ্যে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলাই দক্ষিণ রাজকুন্তি গ্রামের আব্দুল কাদিরের মেয়ে আমেনা (৪০), শেওড়া গ্রামের কাইয়ুমের মেয়ে খাদিজা, জালিয়া গ্রামের মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী শাহানা বেগম, কালিয়ারকান্দা গ্রামের চাঁন মিয়ার ছেলে নাজমুল, বড়খালের পাড়ের আজিজুল হকের মেয়ে মোছা. রহিমা আক্তার (৪০), রঘুনন্দনপুরের মালেকের মেয়ে মাহমুদা বেগম, ব্রাহ্মণকান্দি গ্রামের নিজাম উদ্দিনের মেয়ে শাহানা বেগম (১৬), করিমগঞ্জ উপজেলার মথুরাপাড়া গ্রামের খোকন মিয়ার স্ত্রী জাহানারা (৩৫), আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী পাখিমা (৩৪), তাহের উদ্দিনের ছেলে নাঈম (১৮), দক্ষিণ নানশ্রীর মাসুদের ছেলে সোহাগ (১৩), মুলামখারচরের সুজনের মেয়ে ফাতেমা আক্তার, চাতল গ্রামের সুরুজ আলীর মেয়ে ফারজানা আক্তার, সাঁইটুটা গ্রামের মো. স্বপন মিয়ার মেয়ে শায়লা আক্তার, কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের গৌরিপুর গ্রামের বাচ্চু মিয়ার মেয়ে তাছলিমা বেগম, চান্দু মিয়ার মেয়ে রাবেয়া বেগম এবং মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী গ্রামের মো. সেলিমের মেয়ে সেলিনা বেগম রয়েছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, কিশোরগঞ্জে এ পর্যন্ত কয়জন মারা গেছেন, সে বিষয়ে এখনো কোনো সঠিক তালিকা তাঁরা পাননি। তবে জেলার করিমগঞ্জ, সদর, কটিয়াদী ও মিঠামইন উপজেলার অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। যাঁরা নিখোঁজ, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনওকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। সংশ্লিষ্ট পরিবারকে খাদ্যসহায়তা, ডিএনএ নমুনা দিতে স্বজনদের গাড়িভাড়া এবং লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানান।