কিশোরগঞ্জের হাওরে কোমরপানিতে আধা পাকা ধান কাটছেন কৃষকেরা

পানির তোড়ে ধান হুমকির মুখে পড়ায় তড়িঘড়ি করে আধা পাকা ধান কাটছেন কৃষকেরা। রোববার কিশোরগঞ্জের ইটনার বাহিরচর হাওরে
ছবি: তাফসিলুল আজিজ

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার আধা পাকা ও কাঁচা বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফসল হানির আশঙ্কায় কৃষকেরা প্রায় কোমরপানিতে নেমে তড়িঘড়ি করে কাটছেন আধা পাকা ধান। ফসলের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় আছেন আরও শত শত কৃষক। আকাশে মেঘ দেখলেই আঁতকে উঠছেন তাঁরা।

পানির তোড়ে হুমকির মুখে পড়েছে হাওরের বেশ কয়েকটি ফসল রক্ষা বাঁধ। পরিস্থিতি সামাল দিতে কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে কোদাল-খাদি নিয়ে ফসল রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মসজিদে মসজিদে মাইকিং করেও জমির ধান তড়িঘড়ি করে কাটা ও মাটি ভরাট করে জমি রক্ষার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, দুই দিন ধরে উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনার ধনপুর ইউনিয়নের আফান্ন ও নলুয়ার বিলের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ইটনা সদরের এরশাদ নগর, চিড়া গাঙ, বলদা; এলংজুড়ি, কুলিভিটা, ছিলনী, বাহিরচর, পাঙাশিয়া, জিওলের হাওরসহ কয়েকটি এলাকার উঠতি আধা পাকা ও কাঁচা ধানের জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

পানির চাপে হুমকির মুখে আছে ইটনার জয়সিদ্ধির বাঁধ, জিউল বাঁধসহ কয়েকটি বাঁধ। স্থানীয় কৃষকদের সহযোগিতায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বাঁধ রক্ষায় কাজ করছেন। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও ডুবে যাওয়া ধানের জমি ও এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ চলছে।

ইটনা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সোহাগ মিয়া বলেন, ইতিমধ্যে কয়েক হেক্টর বোরো ফসলের জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া হালালের বাঁধ, জুর বিলের বাঁধ ও জিউলের বাঁধও পানির চাপে হুমকির মুখে আছে। এসব বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আছে। ফসল রক্ষায় কৃষকদের নিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

রোববার সরেজমিনে ইটনার ধনপুর, আফান্নের হাওর, নলিয়ার বিল, ছিলনীর বাহির চরসহ কয়েকটি এলাকায় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকটা দিন পরই পেকে যেত সব ধান। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রি-২৮ ধান পুরোদমে কাটা শুরু হতো। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের পানি এসে ঢুকতে শুরু করেছে। এ নিয়ে তাঁরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন।

ভারতের মেঘালয় ও আসামে ২৬৭ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় উজানের পানির ঢল সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি হয়ে এসে নেমেছে কিশোরগঞ্জের হাওরে।
উজ্জ্বল সাহা, ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা

কৃষকদের ভাষ্য, সহস্রাধিক হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। তবে ইটনা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, সোমবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০০ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগ বিভিন্ন খাল ও নদীতীরবর্তী জমি। মূল বাঁধ উপচে বা ভেঙে এখনো পানি প্রবেশ করেনি। স্থানীয় কৃষক বকুল মিয়া বলেন, রোববার রাতে তাঁর ৪০ শতাংশ জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।

কৃষক মামুন মিয়ার ৫০ শতাংশ ও ফাইজুল মিয়ার প্রায় ৪ একর জমির ধান পানির নিচে। এমন পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে আধা পাকা ধানই কাটতে শুরু করেছেন অনেক কৃষক।

ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জ্বল সাহা সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের মেঘালয় ও আসামে ২৬৭ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় উজানের পানির ঢল সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি হয়ে এসে নেমেছে কিশোরগঞ্জের হাওরে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশি ক্ষতি হয়েছে ধনপুর এলাকার আফান্ন ও নলিয়ার বিলে। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৬৪ হাজার ৪৮৫ হেক্টর। অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৯০ হেক্টর। এর মধ্যে শুধু হাওরাঞ্চলে বোরো চাষ হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর। আর হাওরবহির্ভূত উজান এলাকায় চাষ হয়েছে ৬৩ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, সোমবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০০ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোববার কিশোরগঞ্জের ইটনার বাহিরচর হাওরে
ছবি: প্রথম আলো

গত শনিবার থেকে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান। তিনি বলেন, বৃষ্টিপাতের এই পানি নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরি হয়ে কিশোরগঞ্জের ধনু ও ঘোড়াউত্রা নদীতে প্রবল বেগে আসায় হঠাৎ ৬ থেকে ৭ ফুট পানি বেড়ে যায়। এতে নদীর তীরবর্তী এলাকার কিছু খাল–বিলের জমি তলিয়ে গেছে। তবে মূল হাওরগুলোতে এখনো পানি ঢোকেনি। তিনিসহ তাঁর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ইটনার হাওরে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে স্বস্তির বিষয় এই যে হাওরাঞ্চলের মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে এখন পর্যন্ত এই সমস্যা হয়নি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, হাওরের পরিস্থিতি দেখার জন্য কৃষি বিভাগে কর্মকর্তারা মাঠে আছেন। মূল হাওর এখনো নিরাপদে আছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে ব্রি-২৮ জাতের ধান এবং মাসখানেকের মধ্যে পুরোদমে সব ধান কাটা শুরু হবে। কৃষকেরা তাঁদের স্বপ্নের ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।