কিশোরগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, পানিবন্দী লাখো মানুষ

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে ঘরের ভেতরে হাঁটু পানি। বন্যায় স্ত্রী–সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দী এক বাসিন্দা। সোমবার কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের উরদিঘী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সব নদ-নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, তাড়াইল ও নিকলী উপজেলার বাসিন্দারা।

সরেজমিন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন উপজেলার বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়ক পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে মাছের খামার। এ ছাড়া বন্যার কারণে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে কেউ কেউ গবাদিপশুসহ মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। বন্যার্তদের অনেকে গবাদিপশুসহ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। গত শনিবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। বন্যায় জেলার আট উপজেলার প্রায় ৫০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়েছে ১৫টি গ্রাম।

এদিকে নিকলী উপজেলায় বন্যার ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় নিকলী উপজেলা সদরের গোবিন্দপুর এলাকায় দেখা হয় ষাটোর্ধ্ব রোকেয়া আক্তারের সঙ্গে। তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে ডিঙিনৌকায় কাঁথা–বালিশ, লাকড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, রান্নার জন্য কাটা তরকারিসহ স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসেছেন। রোকেয়ার বাড়ি নিকলী সদরের সীতারামপুর এলাকায়। গতকাল দুপুরে তাঁর ঘরে পানি ওঠায় জিনিসপত্র নিয়ে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসেছেন।

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। নৌকায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে স্বজনদের বাড়িতে ছুটছেন ষাটোর্ধ্ব রোকেয়া আক্তার
ছবি: প্রথম আলো

রোকেয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘুম থাইক্কা উট্টে দেহি ঘরে ফানি উট্টে ফরছে। গত ফনরো ষোল্ল (১৫-১৬) বছরে এমুন ফানি দেহিনা। কালি আমরার বাড়ি না সবার বাড়িতই ফানি উট্টে ফরছে। অহন আমরা দিশবিশ ফাইতাছিনা, কী করবাম। আমি সন্ধ্যার আগেই কিছু জিনিস নিয়া বইনের বাড়িতে আইয়া ফরছি। ঘরে রাখা ধানটানসহ বাকি সবতা ফানির নিচে তলাইয়া গেছে।’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নিকলী উপজেলা সদরের সীতারামপুর, ষাইটধার, কলেজপাড়া, ভবানীপুর, অফিসপাড়া, মির্জাপুর এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়। এ ছাড়া জালালপুর, বড়কান্দা, টেংগুরিয়া, ডুবি, পুড্ডা হাটবাজারসহ নিকলীর অনেক এলাকার বাড়িঘরে পানি উঠেছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বাজারে পানি উঠেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন ওই এলাকার বাসিন্দারা। ইতিমধ্যে আশ্রয়ের জন্য অনেকে ছোটাছুটি করছেন।

নিকলী সদরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম ও শামীম আল মামুন বলেন, ২০০৪ সালের পরে তাঁরা কখনো এত পানি দেখেননি। গত ১৮ বছরে যেসব জায়গায় পানি ওঠেনি, সেসব জায়গায়ও এবার পানি উঠেছে। যেভাবে ঘণ্টায় ঘণ্টায় পানি বাড়ছে, এভাবে বাড়তে থাকলে ২০০৪ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে।

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। সোমবার কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের উরদিঘী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় সিংপুর, দামপাড়া, ছাতিরচর এলাকা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি সদরের অনেক এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। ছাতিরসহ কিছু এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে তাঁরা সতর্ক আছেন। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় সারাক্ষণ কাজ করছেন। পানিবন্দীদের সহযোগিতায় বিভিন্ন এলাকায় টিম গঠন করে দিয়েছেন। বন্যার্তদের সহায়তায় এখন পর্যন্ত ১০ মেট্রিক টন চাল, ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার, ৯০ হাজার টাকার গোখাদ্য, ১ লাখ টাকার শিশুখাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বন্যার্তদের সহায়তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ২০ থেকে ২৫টি নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে ১৪০ মেট্রিক টন চাল, নগদ আড়াই লাখ টাকা ও দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করেছে। এ ছাড়া আরও ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৩৩২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। বর্তমানে ৪ হাজার ৮৯৬ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। এ ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৬৫টি গবাদিপশু আছে। মানুষকে উদ্ধারে পর্যাপ্ত পরিমাণ নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে।