কীর্তনখোলা গিলে খাচ্ছেন ৫ হাজারের বেশি দখলদার

কীর্তনখোলা নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। রোববার বরিশাল নগরের ডিসি ঘাট এলাকায়
ছবি: সাইয়ান

বরিশালসহ গোটা দক্ষিণ অঞ্চলের নৌ যোগাযোগ ও প্রাণ-প্রকৃতির আধার কীর্তনখোলা নদী। পাঁচ হাজারের বেশি দখলদার নদীটি গিলে খাচ্ছেন। এর মধ্যে চার হাজারের বেশি দখলদারের নাম আছে খসড়া তালিকায়। এতে নদীর দুই পার সংকুচিত হচ্ছে। হুমকিতে পড়ছে নদীর জীববৈচিত্র্য ও প্রাণ-প্রকৃতি।

বরিশাল নগরের পশ্চিম ও পূর্ব—দুই পারেই চলছে দখলের মচ্ছব। নদীতে জেগে ওঠা রসুলপুর চর, মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়ার চর, কর্ণকাঠী চর, পলাশপুর চর, খোন্নারের চর, বাড়িয়ার চর ও দপদপিয়া ফেরিঘাট-সংলগ্ন এলাকা দখল করেছেন প্রভাবশালীরা। কেউ নদীর পাড়সীমানা দখল করে গড়ে তুলছেন বিভিন্ন স্থাপনা। আবার কেউ নদীর তীর দখল করে গড়ে তুলছেন ইট, বালু, পাথর ও কয়লা বিক্রির ডিপো ও লঞ্চ তৈরির ডকইয়ার্ড কিংবা ওষুধ ও সিমেন্ট কারখানা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, কীর্তনখোলা নদীর পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে দখলদারের কারণে। আগে কীর্তনখোলা নদীর প্রশস্ত ছিল এক কিলোমিটার। তা দিনে দিনে দখল হয়ে সংকুচিত হয়েছে। কীর্তনখোলা দখল প্রতিরোধ করা না হলে বরিশাল নগর বিপন্ন হবে। কেননা, নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই জীবন্ত সত্তা রক্ষায় প্রশাসনিক উদ্যোগ দ্রুত প্রয়োজন। সব দখলদার উচ্ছেদ করে কীর্তনখোলা নদীকে পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনা হোক, এটাই তাঁদের চাওয়া।

স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কীর্তনখোলা নদীর বরিশাল নগর প্রান্তে আশির দশকে ২৩ একর জমি নিয়ে জেগে ওঠে রসুলপুর চর। এরপর যে দল ক্ষমতায় এসেছে, সে দলের প্রভাবশালীরা চর দখল করে চলেছেন। চরটির আয়তন বেড়ে ৫০ একরে পরিণত হয়। সেখানে বহুতল ভবন থেকে শুরু করে মাছের ঘের, মুরগির ফার্ম, বালুর ব্যবসা, ডকইয়ার্ড ও ছোট ছোট ঘর করে তা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে সেখানকার জমি। খোন্নারের চরে আছে দুটি ইটভাটা। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় চর ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে নদীর তীর দখল করে নির্মিত হচ্ছে পাকা স্থাপনা। নগরের মুক্তিযোদ্ধা পার্ক থেকে ৩০ গোডাউন এলাকা পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে পাড় দখল করে।

আইন অনুযায়ী, নদীর দুই তীরের যে অংশ শুষ্ক মৌসুমে চর পড়ে এবং বর্ষা মৌসুমে ডুবে যায়, তাকে ফোরশো বলা হয়। ওই ফোরশো এলাকায় কারও অধিকার থাকে না। কেউ এ জমি দখল করলে তিনি দখলদার হিসেবে চিহ্নিত হন।

১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের রূপাতলী মৌজার অধীন পূর্ব রূপাতলী এলাকার খলিফাবাড়ি থেকে উত্তরে কাটাদিয়া খাল পর্যন্ত কীর্তনখোলার পশ্চিম তীরে প্রায় দেড় কিলোমিটার ফোরশো দখল করা হয়েছে। ‘স্বপন মিয়ার ডক’ নামে পরিচিত ওই ডকইয়ার্ডে কাজ চলছে। ডকইয়ার্ডটির পাশেই নির্মিত হয়েছে আধা পাকা পোলট্রি খাবারের গোডাউন। পাশেই কয়লার ডিপো থেকে ট্রাক ভরে কয়লা নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।

জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা যায়, বরিশাল নৌবন্দরের উত্তরে আমানতগঞ্জ খাল থেকে দক্ষিণের রূপাতলী সিএসডি গোডাউনের খালের দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫৭০ কিলোমিটার কীর্তনখোলার তীর বিআইডব্লিউটিএর। বাকি অংশ জেলা প্রশাসনের। তবে বন্দরসংলগ্ন নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরে উচ্চ জলরেখা থেকে তীরের দিকে ৫০ গজ পর্যন্ত উভয় তীরে ৩৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ফোরশো আছে, যার অর্ধেকই বেদখলে চলে গেছে। কীর্তনখোলার তীর দখলকারী ৪ হাজার ৩২০ জন অবৈধ দখলদারের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

নদীর তীরের খলিফাবাড়ি এলাকায় মেহগনিগাছ দিয়ে পাইলিং দিয়ে ব্লক ব্যবহার করে বালু ও মাটি ফেলে ভরাট করেছেন স্থানীয় রাইভিউল কবির নামের এক ব্যক্তি। সেখানে তিনি ইট, বালু, পাথর বিক্রির ডিপো ও লঞ্চ তৈরি-মেরামত ডকইয়ার্ড গড়ে তুলেছেন। ব্লক দিয়ে ডকইয়ার্ডের মধ্যে একাধিক দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। এর আগে এখানে রাইভিউল কবির তীরে ইটভাটা করেছিলেন। প্রশাসনিক চাপে ওই ইটভাটা বন্ধ করেন।

পূর্ব রূপাতলী এলাকার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধান গবেষণা রোডের পাকার মোড় এলাকায় কীর্তনখোলা তীরের খলিফাবাড়ি পয়েন্ট থেকে গাইড ওয়াল করে বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশে এই বালু ভরাট করা হয়েছে। এরপরও কয়েক হাত দূরে বাঁশ ও লাঠির বেড়া দিয়ে ওই অংশও দখল করেছেন। রাইভিউল কবির নানা কৌশলে কাগজপত্র তৈরি করে কীর্তনখোলা তীরের বিশাল অংশের মালিক হয়েছেন। এখন নদীর অংশ দখল করে আয়তন বাড়াচ্ছেন। দুই বছর আগে নদীর তীরের ওই অবৈধ দখল গুঁড়িয়ে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন।

অভিযোগের বিষয়ে রাইভিউল কবির বলেন, খলিফাবাড়ি থেকে কাটাদিয়া খাল পর্যন্ত কীর্তনখোলা তীরে তার প্রায় ১৭ একর রেকর্ডীয় সম্পত্তি আছে। যেখানে পাইলিং দেওয়া হচ্ছে, সেখানে তাঁদের একটি দাগে ৫৯ শতাংশ জমি ছিল। এখন আছে ২৫ শতাংশ। বাকিটা নদীতে ভেঙে গেছে। ভাঙন ঠেকাতেই পাইলিং দিয়ে মাটি ফেলা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, বিআইডব্লিউটিএকে সঙ্গে নিয়ে দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। তালিকা চূড়ান্ত হলেই উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা হবে। পূর্ব রূপাতলী এলাকায় কীর্তনখোলা দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নদীতীরে কারও ব্যক্তিগত জমি থাকলে আইন অনুযায়ী তিনি সেখানে কোনো স্থাপনা করতে পারেন না। নদী দখল করা বেআইনি। দখলদারের বিরুদ্ধে সরেজমিনে খোঁজখবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও নদীবন্দর কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নগরের আমানতগঞ্জ খাল থেকে রূপাতলী দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫৭০ কিলোমিটার কীর্তনখোলার তীর বিআইডব্লিউটিএর। নদীর তীরের দিকে ৫০ গজ পর্যন্ত উভয় তীরে ৩৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ফোরশো আছে, যার অর্ধেকই দিনে দিনে বেদখল হয়ে গেছে।