কুয়াকাটা সৈকত মুখরিত

পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় রাসপূজা উপলক্ষে পুণ্যস্নানে হিন্দুধর্মের পুণ্যার্থীদের ঢল। ছবিটি গতকাল সকালে তোলা l প্রথম আলো
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় রাসপূজা উপলক্ষে পুণ্যস্নানে হিন্দুধর্মের পুণ্যার্থীদের ঢল। ছবিটি গতকাল সকালে তোলা l প্রথম আলো

হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় সাগরটা তুলনামূলক শান্ত। ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে কিনারায়। পূর্ণিমার চাঁদের আলো তখনো আকাশে মিলিয়ে যায়নি। অন্ধকার দূর হয় হয় অবস্থা। হালকা মেঘে পুব আকাশটা একটু ভারী হয়ে আছে, ঠিক এমন আবহের মধ্যে হিন্দু নারীদের উলুধ্বনিতে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত সরগরম হয়ে উঠল। যে যার মতো এসে পুণ্যস্নানের জন্য নামতে লাগলেন সাগরে। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ রাসভক্তদের আনাগোনা। এ সময়টায় সবার ব্যস্ততা পূজার জন্য। নিশি ভোরের ওই লগ্নে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে সাগরকন্যা কুয়াকাটা হয়ে উঠেছিল মুখরিত।

শুক্রবার রাতভর হিন্দু পুণ্যার্থীরা কুয়াকাটার ‘রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও তীর্থযাত্রী সেবাশ্রম’ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় রীতিতে অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেক হিন্দু নরনারী বিশ্বাস করেন, সারা বছরের পঙ্কিলতা দূর হয়ে সামনের জীবন হবে সুখের, সংসারকর্মে আসবে সাফল্য। তাই পুরো রাত জেগে তাঁরা সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য পাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে রাসভক্ত পুণ্যার্থীরা পুণ্যস্নানের ক্ষণটির জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন। প্রচ্ছন্ন কুয়াশা আর হালকা ঠান্ডায় গতকাল শনিবারপ্রত্যুষের ওই মুহূর্ত সব শ্রেণির মানুষকে যেন আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল।

শুধু নিজে নয়, পরিবারের সদস্যদেরও ধর্মীয়ভাবে সিদ্ধ করতে বাহুতে জড়িয়ে হিন্দু নরনারীদের অনেকে নেমে পড়েছেন স্নানে। এ রকমই একজন বাগেরহাটের সুস্মিতা বড়াল। তিনি বললেন, ‘নানা রকম সমস্যার মধ্যেই এ বছরটা পার করেছি। সামনের দিনগুলো যাতে ভালো কাটে, সে মনোবাসনা নিয়ে পুণ্যস্নান করতে এসেছি। ভালোভাবে ধর্মীয় আচার পালন করতে পারায় নিজের কাছে ভালো লাগছে।’

সত্যরঞ্জন দাস নামে একজন সাগরের পানিতে নেমে মনে মনে কী যেন জপতে লাগলেন। খানিক পর দুহাতে সাগর থেকে পানি নিয়ে স্ত্রী-পুত্রের মাথায়-গায়ে ঢেলে দিলেন। এভাবে ভক্তকুলের নানান রকমের নিয়ম-রীতি পালন করতে দেখা গেল। কেউ নিজের জন্য, আবার কেউ স্বর্গবাসী মা-বাবার জন্য মানত করে সৈকতের বালুচরে বসে মাথা ন্যাড়া করেন। বিমল শিকদার নামের এক ভক্ত বলেন, ‘বাবা মারা গেছেন কয়েক মাস হলো। তাঁর নামে মানত করেছিলাম। পূর্ণিমার তিথিতে রাসপূজার সময় মাথা ন্যাড়া করে সে মানত রক্ষা করলাম।’

পটুয়াখালীর তমালিকা দেবনাথ নামে এক পুণ্যার্থী কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুণ্যার্থীদের স্নানের পর সৈকতে কাপড় পরিবর্তন করার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। আমরা নিজেরাই সৈকতের পাড়ে কাপড় ঘেরা দিয়ে স্নানের কাপড় পরিবর্তন করেছি। স্থানীয় প্রশাসনের এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল করা উচিত ছিল।’

এর আগে শুক্রবার রাত আটটায় পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. মাছুমুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাসের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মিনিস্টার এস বি এস টোমার, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নিম চন্দ্র ভৌমিক, কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব তালুকদার, কলাপাড়া পৌরসভার মেয়র বিপুল চন্দ্র হাওলাদার প্রমুখ।

শত বছরের ঐতিহ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের এই রাস মেলা এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। অন্য ধর্মের নারী-পুরুষেরাও এ রাস মেলা দেখতে কুয়াকাটায় এসেছিলেন। সব শ্রেণির মানুষের উপস্থিতির কারণে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। রাস মেলাকে কেন্দ্র করে কুয়াকাটা সৈকত ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পূজার সামগ্রী, ফিতা-চুড়ি, শামুক-ঝিনুকসহ নানান ধরনের খেলনার দোকান বসেছিল। তা ছাড়া খাবার হোটেলগুলোতেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। প্রচুর বেচাকেনাও হয়েছে। মিলন ব্যাপারী নামের এক দোকানদার জানালেন, গতবারের চেয়ে এবার তাঁর বিক্রি ভালো হয়েছে। খরচ বাদ দিলে ২০ হাজার টাকার মতো তাঁর লাভ হবে। কেউ কেউ আবার খাবার হোটেল-আবাসিক হোটেলে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। খুলনার বাসিন্দা রামলাল বিহারী মজুমদার বলেন, ‘এর আগে কুয়াকাটায় এসে দেড় হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে যে রুমে থেকেছি, এবার সে রুমের ভাড়া আড়াই হাজার টাকা রাখা হয়েছে।’ খাবার হোটেলেও তুলনামূলক দাম বেশি রাখা হয়েছে বলে তিনি জানালেন। তাঁর মতো আরও কয়েকজন পর্যটক-দর্শনার্থী আবাসিক হোটেলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।

এদিকে স্নান শেষে পুণ্যার্থীরা কলাপাড়া পৌর শহরের মদন মোহন সেবাশ্রমে এসে সমবেত হতে শুরু করেছেন। ১১৭ বছর ধরে এখানে ধর্মীয় আচার পালন করার রীতি প্রচলিত রয়েছে, যার জন্য রাধা-কৃষ্ণের ১৭ জোড়া যুগল মূর্তি এ মন্দির প্রাঙ্গণে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। হাজার হাজার রাসভক্ত স্নান শেষে রাধাকৃষ্ণের এসব যুগল মূর্তি দর্শন করে যাঁর যাঁর বাড়িতে ফিরে যাবেন। তা ছাড়া প্রতিবছরের মতো এ বছরও কলাপাড়া পৌর শহরের মদন মোহন সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে তিন দিনের মেলা বসেছে। নানান পণ্যের পসরা নিয়ে মেলায় এসেছেন দোকানিরা। মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়াও আশপাশের রাস্তায় বসেছে অসংখ্য দোকানপাট।