ক্রীড়াঙ্গন স্থবির, স্টেডিয়ামে চরে গরু-ছাগল

প্রায় ১৩ একর জায়গা নিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের হোসেনপুরে শহীদ শামসুদ্দিন স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকে চোখ পড়ল মাঠ ছেয়ে থাকা তরতাজা সবুজ ঘাসের দিকে। হেমন্তের বেলা শেষে মিঠে রোদ এসে পড়েছে তার ওপর। একপাল গরু-ছাগল সেই ঘাস চিবিয়ে উদর পূর্তি করছে।
স্টেডিয়ামের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের প্রাচীরের অনেকখানি জায়গা ভেঙে পড়েছে। পাশেই বিশাল জলাভূমি। ভাঙা দেয়ালের কিনার থেকে মাঠের ভেতরেও অনেকটা জায়গা ধসে পড়েছে। দর্শক গ্যালারির সামনে লাগানো লোহার গ্রিলও ভাঙা। গৃহপালিত চতুষ্পদেরা এই ভাঙা অংশ দিয়েই মূলত স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেছে। তবে প্রধান ফটকও খোলা থাকে। সে পথেও তাদের আগমনে বাধা নেই। না থাকাই সংগত, কারণ এই স্টেডিয়ামে খেলাধুলা বলতে গেলে এখন আর তেমন হয় না। সারা বছর গরু-ছাগলই চরে বেড়ায়।
জেলার খেলাধুলার অবস্থা জানতে সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। একবাক্যে সবাই বলেছেন, ‘সিরাজগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গন এখন স্থবির।’ জেলা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হারুন অর রশিদ খান বলেন, ২০০৯ সালের পর আর জেলায় ফুটবল লিগ মাঠে গড়ায়নি। জেলায় ফুটবল দল আছে ২০টির মতো। এককালে সিরাজগঞ্জের ফুটবলের বেশ নামডাক ছিল উত্তরাঞ্চলে। একসময়ের জাতীয় দলের দলনেতা মাসুদ রানা সিরাজগঞ্জেরই কৃতী ফুটবলার। এ ছাড়া জাতীয় দলে খেলেছেন সজীব সিরাজী। ঢাকায় প্রথম বিভাগে খেলেছেন হিলটন, মালেক, রতনসহ অনেকে। এখন সেই সিরাজগঞ্জে কোনো ফুটবল লিগ হয় না। দীর্ঘদিন পর এই বছর স্থানীয় সাংসদ হাবীবে মিল্লাত ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁর বাবার নামে ডা. ছানাউল্লাহ আনসারী ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন। এটি ছিল সদর ও কামারখন্দ উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের টুর্নামেন্ট। জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে ফুটবল লিগের জন্য প্রতিবছর অন্তত তিন মাসের জন্য ফুটবল ফেডারেশনকে মাঠ বরাদ্দ দেওয়ার কথা। কিন্তু দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করলেন এই ফেডারেশনের সভাপতি। এই হলো ফুটবলের অবস্থা।
সিরাজগঞ্জে একমাত্র ক্রিকেটেরই প্রথম বিভাগ লিগ হয়। তবু সেটি দুই থেকে তিন বছর পরপর এবং স্পনসর পাওয়া সাপেক্ষে। চলতি বছরের শুরুতে একটি প্রথম বিভাগ লিগ হয়েছে ১০টি দল নিয়ে। এর আগের লিগ হয়েছিল ২০১৩ সালে। এখানে দ্বিতীয় বিভাগে লিগ
হয় না। তাই দলও নেই। শহরের কৃতী ক্রিকেটার আবদুল্লাহ-আল মামুন ঢাকায় বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগে খেলেছেন ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এখন বিসিবির জেলা ক্রিকেট কোচ। নিজেও একটি ক্রিকেট একাডেমি চালান। তিনি বললেন, একে তো নিয়মিত লিগ হয় না, তার ওপর জেলা ক্রীড়া সংস্থার (ডিএসএ) নিয়ম অনুসারে প্রথম বিভাগের ক্লাবগুলোই লিগে অংশ নিতে পারে। অথচ দ্বিতীয় বিভাগের লিগ নেই। ফলে নতুন ক্রিকেটাররা প্রথম বিভাগের লিগে অংশ নিতে পারছেন না। তাই সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নতুন ক্রিকেটার বের হয়ে আসতে পারছেন না। তরুণ প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে এ নিয়ে বেশ হতাশা দেখা গেল।
জেলায় ভলিবলের ক্লাব আছে ছয়টি। এর মধ্যে সদরের ভদ্রঘাট ইউনিয়ন এবং উল্লাপাড়া উপজেলার ভলিবল দলে অনেক কৃতী খেলোয়াড় আছেন। এলাকায় নামডাকও আছে। তবে ভলিবলের লিগ নিকট অতীতে কবে হয়েছে, তা ডিএসএর কর্তারাও বলতে পারেননি। ক্রীড়া সংগঠক ও ডিএসএর কোষাধ্যক্ষ ফুলাদ হায়দার খান বলেন, ডিএসএর আয়োজনে ভলিবল লিগ হয় না। ফলে ভলিবল খেলোয়াড় স্টেডিয়ামের বাইরের বিভিন্ন মাঠে, বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজমাঠে নিজেরাই মাঝেমধ্যে টুর্নামেন্টের আয়োজন করেন। একই অবস্থা ব্যাডমিন্টনের ক্ষেত্রেও। শীতের মৌসুমে খেলোয়াড়েরাই ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের আয়োজন করেন।
অন্য প্রধান খেলার মধ্যে ডিএসএর দাবা, কাবাডি, টেবিল টেনিস ও তায়কোয়ান্দোর কমিটি রয়েছে জেলা ক্রীড়া পরিষদে। এগুলোর ও লিগ হয় না। এর মধ্যে এ বছর জেলা পুলিশের ব্যবস্থাপনায় কাবাডি লিগ হয়েছে। জেলার ১১টি থানার দল এতে অংশ নিয়েছে। নিয়ম অনুসারে প্রতিবছর ন্যূনতম পাঁচটি খেলার লিগ হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। এমনকি কোনো কোনো বছর একটি লিগও হয় না। ডিএসএর কোষাধ্যক্ষ বললেন, মূলত অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখানে লিগ হচ্ছে না। পাঁচটি লিগ করতে গেলে ন্যূনতম ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা লাগে। ডিএসএ সারা বছরে খেলাসহ অন্যান্য খরচের জন্য বরাদ্দ পায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। অন্যান্য জেলায় ডিএসএ হাউজি চালায়। সেখান থেকে ভালো আয় আসে। সিরাজগঞ্জ ডিএসএ হাউজি পরিচালনা করে না। ফলে ডিএসএর আর কোনো আয় নেই। স্পনসর পেলে, পৃষ্ঠপোষক পেলে লিগ হয়, না হলে হয় না।
জেলা ক্রীড়া সংস্থা লিগ আয়োজন না করলেও শিক্ষা বিভাগের আয়োজনে স্কুল পর্যায়ে প্রতিবছর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। বলতে গেলে জেলায় এই দুটি টুর্নামেন্টই নিয়মিত হচ্ছে।
ডিএসএর সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে ১০ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে আবেদন করা হয়েছে। পরিষদের একটি দল স্টেডিয়াম পরিদর্শন করে গেছে। টাকা পেলে সংস্কারকাজ শুরু হবে। লিগ হচ্ছে না এটা ঠিক। তবে এ জন্য জেলার ক্রীড়ামোদী ও ডিএসএর সব কর্মকর্তা—সবাইকে উদ্যমী হতে হবে।
ডিএসএর সম্পাদক গাজী শফিকুল ইসলাম বললেন, স্টেডিয়াম সংস্কার না করার কারণে লিগ করা যাচ্ছে না। টাকার অভাবও রয়েছে। তবু স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।