ক্ষমতাসীনেরা উদ্যোগ নিলে নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এড়ানো যেত

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গত শুক্রবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে প্রায় তিন ঘণ্টা তাণ্ডব চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১২টি মন্দির, বেশ কিছু দোকানপাট ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় একদল দুর্বৃত্ত। হামলায় নিহত হন ইসকনের দুই ভক্ত। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এ পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলো কথা বলে নোয়াখালী জেলা বারের সাবেক সভাপতি ও নোয়াখালী নাগরিক অধিকার মোর্চার আহ্বায়ক মোল্লা হাবিবুর রাসুলের সঙ্গে।

নোয়াখালী জেলা বারের সাবেক সভাপতি ও নোয়াখালী নাগরিক অধিকার মোর্চার আহ্বায়ক মোল্লা হাবিবুর রাসুল
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কুমিল্লার ঘটনার পর নোয়াখালীতে যে ঘটনা ঘটে গেল, সেটি ঠেকানো যেত কি?

মোল্লা হাবিবুর রাসুল: কুমিল্লার ঘটনা যে-ই করুক, উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেছে। এটাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে আমাদের নোয়াখালীর চৌমুহনীতে যে নারকীয় তাণ্ডব ঘটেছে, আমি মনে করি প্রকৃতভাবে যাঁরা ধর্মকর্ম পালন করেন, তাঁরা কাজটি করেননি। উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও সুযোগসন্ধানী কিছু ব্যক্তি, যারা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত থাকে, তারা কাজটি করেছে বলে আমরা মনে করি।
কুমিল্লার ঘটনার পর সারা দেশের পূজামণ্ডপে অধিকতর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। বিসর্জনের দিন যেহেতু জুমার দিন ছিল, প্রশাসন যদি সতর্কতা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিত, তাহলে নিঃসন্দেহে এ তাণ্ডব ঠেকানো যেত। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ ছিল না বলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা কেমন ছিল বলে মনে করেন?

মোল্লা হাবিবুর রাসুল: আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা কতটুকু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে, সে বিষয় বারবার আমাদের সামনে চলে আসে। কুমিল্লার ঘটনার পর প্রশাসন উদ্যোগ না নিলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যদি স্থানীয় পর্যায়ের নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে দলমত–নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে এ সহিংসতা এড়ানো যেত। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাঁরা সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের জন্য কী করা উচিত?

মোল্লা হাবিবুর রাসুল: মন্দির-বাড়ির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুনর্নির্মাণ করে দেওয়ার দায়িত্ব সরকার বা প্রশাসনের। আর ব্যক্তিগতভাবে যে ক্ষতি হয়েছে, সে ব্যাপারেও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা কেন ঘটছে?

মোল্লা হাবিবুর রাসুল: আমাদের দেশে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কেন বারবার হচ্ছে, এটা এককথায় বলা কঠিন। আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার যে মূলনীতি, তার প্রতি আমাদের দেশের মানুষের কতটুকু বিশ্বাস আছে, সে প্রশ্ন নতুন করে মনে জাগছে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের দেশের বড় দলগুলোর উচিত তাদের সভা-সমাবেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমূলক অবস্থান গ্রহণ করা। আরেকটি বিষয়, যেখানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সেখানে আবার রাষ্ট্রের একটি ধর্ম থাকা—বিষয়টি সাংঘর্ষিক। অনেক বিষয় এটার জন্য দায়ী। এ দেশের মানুষ ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল, সেই চেতনা জাগ্রত হলে সত্যিকার অর্থে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা যাবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নোয়াখালীতে এর আগে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হামলা মামলার বিচার নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মোল্লা হাবিবুর রাসুল: যেসব ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ রয়েছে, সেগুলো দেখে যারা এ ঘটনায় অংশগ্রহণ করেছে, তাদের চিহ্নিত করে মামলা করা উচিত। একটি ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীর সঙ্গে অনুমানের ভিত্তিতে যদি কাউকে যুক্ত করা হয়, তাহলে মূল মামলাটা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে রাজগঞ্জের ঘটনা একটা উদাহরণ হতে পারে। ঘটনাটি ঘটল ২০১৩ সালে। সেই মামলায় এতসংখ্যক লোককে যুক্ত করা হয়েছে; ওই মামলার বিচারকাজ মাত্র শুরু হলো! কবে নাগাদ শেষ হয়, সেটি দেখার বিষয়। সুতরাং সুনির্দিষ্টভাবে আসামি চিহ্নিত করে, মামলা করে, অভিযোগপত্র দিয়ে দ্রুত বিচার শেষ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।