খননে প্রাণ পেল ‘লছিধারা খাল’

স্বেচ্ছাশ্রমের খননে পুরোনো খালটিই জেগে উঠেছে সম্পূর্ণ নতুন চেহারায়। খালটিতে এখন টলটল করছে পানি।

স্বেচ্ছাশ্রমে খননের পর ‘লছিধারা খাল’। ১ মার্চ মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বিন্নার হাওরে
ছবি: প্রথম আলো

কিছুদিন আগেও ধানের খেত ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। মাঠজুড়ে পড়ে ছিল কেটে নেওয়া আমন ফসলের ধূসর নাড়া। বিস্তীর্ণ মাঠে গরুর পাল চরে বেরিয়েছে। এ রকম একটি মাঠে খাল ছিল। তাতে পানি ছিল। নৌকা চলাচল করত। এটা কারও কল্পনাতেও আসার সুযোগ ছিল না। কেবল তাঁরাই মনে করতে পারতেন, যাঁদের চোখের সামনে একটি খাল মরে গিয়েছিল। যাঁরা এ ধানখেতের বুক থেকে একটা খাল হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস জানতেন।

তবে কিছু মানুষের উদ্যোগ, প্রশাসনের সহযোগিতা সেই রকম একটি মৃত খালকে পুনর্জীবন দিয়েছে। স্বেচ্ছাশ্রমের খননে পুরোনো খালটিই জেগে ওঠেছে সম্পূর্ণ নতুন চেহারায়। খালটিতে এখন টলটল করছে পানি। খননের পরই পাশের বোরো ফসলের জমিতে শুরু হয়েছে সেচ প্রদান। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বিন্নার হাওরে হারিয়ে যাওয়া ‘লছিধারা খাল’ এভাবেই ফিরে এসেছে পানির এক উৎস হয়ে।

১ মার্চ বিন্নার হাওর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লছিধারা খালটির খননকাজ শেষ হয়ে গেছে। মোকামবাজার অফিসের বাজার পাকা সড়ক থেকে উত্তরে কোদালীছড়া পর্যন্ত খালটিতে টলটল করছে পানি। খাল খনন শেষে কোদালীছড়া থেকে এ পানি লছিধারা খালে এসে ঢুকেছে। নতুন খালটি থেকেই কেউ কেউ সেচযন্ত্র লাগিয়ে তাঁদের বোরো ফসলের জমিতে সেচ দিচ্ছেন। অনেকের কাছেই খালটি এখন এক বিস্ময়। কেউ ভাবতেও পারেননি ৪০ থেকে ৫০ বছর আগে খালটি হারিয়ে পুরোটাই ফসলের জমিতে পরিণত হয়েছে। সেটা আবার তার জলভরা চেহারা নিয়ে এ রকম ফিরতে পারবে।

দক্ষিণ ভুজবল গ্রামের সাজ্জাদ মিয়া বলেন, ‘খাল অওয়ার (হওয়ার) পর পয়লা আমি পানি কাজে লাগাইছি। খাল না অইলে (হলে) অত সহজে খেতো পানি দিতাম পারতাম না। দূর থাকি পানি আনতে অইতো (হতো)। লস অইতো। খালে আমার খুব উপকার অইছে (হয়েছে)। হাঁস চাইরটা পালিয়া (পোষা) রাখা যাইবো। মাছও মিলবো।’

খাল খননের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গত ৩০ জানুয়ারি বিন্নার হাওরের ভুজবল এলাকায় খাল খননের কাজ শুরু হয়েছিল। জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান খনন কাজের উদ্বোধন করেছিলেন। উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক কাজী লুৎফুল বারী, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাবরিনা রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জামান, সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম, গিয়াসনগর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোশাররফ প্রমুখ। খননযন্ত্রের সাহায্যে খালটি সম্পূর্ণ খনন করতে প্রায় ২০ দিন সময় লেগেছে। খালের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৫০ ফুট। গভীরতা ৬ থেকে ৮ ফুট। প্রশস্ততা প্রায় ৩০ ফুট। এলাকার জমির মালিক ও প্রবাসীরা এ খননের টাকার জোগান দিয়েছেন। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকা।

প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বিন্নার হাওরের লছিধারা খালটি ভরাট হয়ে খেতের জমির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। খালটি বিন্নার হাওরের পানিনিষ্কাশন, সেচ ও মাছের অন্যতম উৎস ছিল। প্রায় ৫০ বছর আগেও এ খালে নৌকা দিয়ে মাঠ থেকে ধান পরিবহন করা হতো। ধীরে ধীরে খালটি হারিয়ে গেলে সেচসংকটে পড়েন এলাকার কৃষকেরা। পানির সুবিধা না থাকায় অনেক জমিই পতিত পড়ে থাকে। শুকনো মৌসুমে প্রায় দেড়-দুই হাজার ফুট দূরত্বের কোদালীছড়া থেকে সেচপাম্পের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা করে কিছু কৃষক বোরো চাষ করেন। এতে এক কিয়ার জমিতে শুধু সেচ খরচই আসে প্রায় তিন হাজার টাকা। সম্প্রতি স্থানীয় কৃষক ও জমির মালিকেরা লছিধারা খালটি পুনরুদ্ধারের জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপরই জেলা প্রশাসন, পাউবো এবং কৃষি বিভাগ সমন্বিতভাবে লছিধারা খালের অবস্থান চিহ্নিত করে দিয়েছে। খালটি খনন হওয়ায় আজমেরু, ভুজবল, গয়ঘরসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের শতাধিক কৃষক পরিবার উপকৃত হবেন।

স্বেচ্ছাশ্রম কাজের সমন্বয়ক জাহেদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসন খালের জায়গা চিহ্নিত করে দিয়েছে। ডিসি মহোদয়, ইউএনও, চেয়ারম্যানসহ সবাই সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। এই খাল হওয়ায় ন্যূনতম ৩০০ একর জমি সরাসরি চাষের আওতায় আসবে।’ তিনি বলেন, ‘যারা খাল দখল করেছিল, তারা নানা সমস্যা সৃষ্টি করেছে। খালে পানি আসার পর এখন সবাই সহযোগিতা করছে। জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা এলাকার মানুষ মনে রাখবে।’