খাগড়াছড়ির বীণা ত্রিপুরার জীবন জয়ের গল্প

প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে মাস্ক সেলাই করছেন বীণা রানী ত্রিপুরা। খাগড়াছড়ি শহরের খাগড়াপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বীণা রানী ত্রিপুরার (৩৮) জীবন জয়ের গল্পটা অন্য রকম। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন বাবা-মা। সুখের আশায় বিয়ে দিলেও স্বামী-সংসার বীণার জীবনে সুখ আনেনি। কয়েক বছর না যেতেই শুরু হয় অশান্তি। এর মধ্যে ঘর আলো করে আসে দুই সন্তান। একসময় নেমে আসে আরও ঘন অন্ধকার। ২০১৫ সালে হয়ে যায় বিচ্ছেদ।

তবে হেরে যাননি বীণা ত্রিপুরা। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কাপড় সেলাই করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। এখন প্রতি মাসে আয় করছেন ৪০ হাজার টাকারও বেশি। শুধু নিজে জীবনযুদ্ধে জয়ী হননি, শতাধিক নারীকেও করেছেন স্বাবলম্বী। ২৩০ জন নারীকে নিজ উদ্যোগে দিয়েছেন সেলাই প্রশিক্ষণ। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় যুব পুরস্কার।

বীণা রানী ত্রিপুরার বাড়ি খাগড়াছড়ি শহরের খাগড়াপুর এলাকায়। ছোট্ট ঘরে দুটি কক্ষ, একটি বারান্দা। সেখানেই তাঁর হেমী টেইলার্স ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। একটি কক্ষে সন্তানদের নিয়ে তিনি বসবাস করেন, একটি কক্ষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সম্প্রতি তাঁর বাড়ি গিয়ে কথা হয় প্রশিক্ষণ নিতে আসা বৈশাখী ত্রিপুরা ও মনিকা আক্তারের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, সংসারে আর্থিক জোগান দিতে এক মাস ধরে সেলাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাঁরা। পুরোপুরি শেখা শেষ হলে সেলাই মেশিন কিনবেন। আর বাড়িতে কাপড় সেলাই করা শুরু করবেন।

কথা হয় বীণা রানী ত্রিপুরার সঙ্গে। তাঁর পথচলা খুব একটা সহজ ছিল না। বললেন, ‘বিয়ের পর জঙ্গল থেকে লাকড়ি নিয়ে আসতাম। কোমড় তাঁতে কাপড় বুনতাম। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালন থেকে সবজি চাষ—সবই করেছি। চাষের টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছি। সংসারে বনিবনা না হওয়ায় আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এটি সহজ ছিল না। সমাজ ও পরিবার ভালোভাবে নেয়নি। বিচ্ছেদকালে মেয়ে পড়ত চতুর্থ শ্রেণিতে। আর ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল।’

ক্লান্ত কণ্ঠে বীণা বলে যান তাঁর গল্প। বলেন, ‘স্বামীর ঘর থেকে বের হয়ে আসার পর আপনজনেরা সরে যেতে থাকেন। তখনই প্রতিবেশী এক মাসির (চন্দনা ত্রিপুরা) পরামর্শে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ছয় মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ নিই। পরে মায়ের কিনে দেওয়া পুরোনো সেলাই মেশিন দিয়ে টুকটাক সেলাই করতে থাকি। প্রথম দিকে তেমন কাজ পাইনি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। এক সময় ঠিকই কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণের জন্য আবেদন করি। কিন্তু এখানেই বাধে বিপত্তি। স্বামী না থাকায় ঋণ দিতে চায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। পরে একজনের সহায়তায় যুব উন্নয়ন থেকে ৫০ হাজার টাকা ব্যবস্থা হয়। আর প্রতিবেশী মাসির দেওয়া ২০ হাজার দিয়ে দুটি সেলাই মেশিন ও গজ কাপড় নিয়ে আসি। গড়ে তুলি মেয়ের নামে “হেমী টেইলার্স এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র”। মোড় ঘুরে যায়। বিক্রি বাড়ে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করি।’

বর্তমানে বীণার টেইলার্স ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রে রয়েছে আটটি সেলাই মেশিন। ঘর করার জন্য শহরেই কিনেছেন দুই লাখ টাকা দিয়ে পাঁচ শতক জমি। ছেলে অর্কিড ত্রিপুরা ঢাকায় একটি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন। মেয়ে হেমী ত্রিপুরা পড়ছে দশম শ্রেণিতে। বীণা ভুলে যাননি স্বামীর নির্যাতনের দিনগুলো। তাঁর ভাষ্য, স্বামীর নির্যাতনে পিত্তথলি ফেটে যায় তাঁর। শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন এখনো বহন করছেন। কিন্তু সমাজের কিছু মানুষের মুখে প্রতিনিয়ত নেতিবাচক কথা শুনতে হয়।

বীণা ত্রিপুরার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে চার বছর আগে সেলাই শিখেছিলেন মাটিরাঙ্গার গোমতি এলাকার মল্লিকা ত্রিপুরা। তিনি বলেন, টাকাপয়সা ছাড়াই বীণা দিদির কাছ থেকে সেলাই শিখেছিলেন তিনি। এরপর একটা টেইলার্সের দোকান দেন। প্রতি মাসে আয় হয় ৭-৮ হাজার টাকা।

বীণা শোনালেন স্বপ্নের কথাও। বললেন, স্বপ্ন দেখেন বড় প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলার। যেখানে অসহায় নারীরা বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। আর একদিন বাল্যবিবাহ দূর হবে সমাজ থেকে। পাহাড়ের নারীরা দক্ষতায় এবং শিক্ষায় এগিয়ে যাবেন।

খাগড়াছড়ি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, বীণা ত্রিপুরা একজন সংগ্রামী নারী। নিজের প্রচেষ্টায় আজ অনেক দূর এগিয়েছেন।