খাবারের স্বাদে জলিলের টংদোকানে

জলিলের হোটেলে ক্রেতাদের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে অনেকটা ভেতরে যেতেই দেখা গেল লম্বা করে চেয়ার-টেবিল পাতানো ঘরটায় মানুষের কোলাহল। কেউ টেবিল-চেয়ারে বসে খাচ্ছেন, কেউ জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। এর মধ্যে দূরদূরান্তের লোকজনও আছেন। বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের পাশে পটুয়াখালীর বাঁধঘাট বাজারে চোখে পড়বে এই হোটেলের। নাম ‘জলিল হোটেল’। কাঠের টংঘরের ওপরে টিনের ছাউনি আর চারপাশে চেরাই কাঠের রেলিং। এই হোটেলেই ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে সকাল-দুপুর-রাতের খাবারের জন্য।

পটুয়াখালী সদরের টেপুরা গ্রাম থেকে তিন ভাই মিলে জলিল হোটেলে খেতে এসেছেন। আয়েশ করে খাচ্ছিলেন। কী দিয়ে খাচ্ছেন—জানতে চাইলে শাহিন মিয়া হেসে বললেন, ‘ডাইল খাসি। খুব মজা। এরপর দুধ আর কলা দিয়া খামু।’ আরেক ভাই টিপু মিয়া বললেন, ‘বাজারে আইলে মোরা রিকশাভাড়া দিয়া এইহানে আইয়্যাই খাই। এইহানের খাওন খুব মজা, বাড়ির মতো স্বাদ আর দামেও সস্তা।’

বড় বিঘাই থেকে হোটেলে খেতে এসেছেন লিজা বেগম ও তাঁর স্বজনেরা। তিনি বলছিলেন, শহরে কাজে এলে এখানেই দুপুরের খাবার সারেন তাঁরা। খাবারের মান ভালো, দামেও সস্তা। এ জন্যই এখানে আসা তাঁদের।

সোমবার দুপুরে এই হোটেলে ঢুকে দেখা গেল, প্রবেশমুখে উন্মুক্ত রান্নাঘর, আরেকটা কক্ষে চাল-সওদা রাখার ঘর। রান্নাঘরে একসঙ্গে তিনটি উনুন জ্বলছে। রান্না করছিলেন বাবুর্চি মজিবর রহমান। মজিবর ১৪ বছর ধরে এই হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন। কেন দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এখানে আসেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই হানে কোনো ভ্যাজাল খাওন না, মেডিসিন নাই, সব ফ্রেশ খাওন। কাস্টমার য্যারা আয়, সবাই চোহের সামনে দ্যাহেন, হেইর পর খায়।’

হোটেলের ৭ জন কর্মচারী। তাঁরা ক্রেতার ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। হোটেলের মালিক আবদুল জলিল নিজেও ভিড় সামলানোর কাজে যুক্ত হন। তাঁর ছেলে রবিউল ইসলাম ক্যাশ সামলাচ্ছেন। নদ-নদীর তাজা মাছ, ছোট চিংড়ি ভুনা, শাকসবজি, মাংস আর বিশেষ আইটেম দুধ-কলা দিয়ে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে।

কথা হয় আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী হেদায়েত উল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘পেশাগত কাজের সূত্রে বেশ কয়েকবার কুয়াকাটায় আসতে হয়েছে। বছর দেড়েক আগে আমাদের একজন সহকর্মীর কাছে শুনে এই হোটেলে খেয়েছিলাম। সেই মুগ্ধতা থেকে যখনই এখানে আসি, তখনই এখানে একবেলা খাওয়ার ইচ্ছাটা পুষে রাখি। খাবারের মান ভালো। ভেজাল নেই। সব টাটকা। তেল-মসলার ব্যবহারও কম।’

দুপুরের খাবার খেতে আসা ক্রেতাদের সামলাতে গলদঘর্ম অবস্থা এই হোটেলের মালিক আবদুল জলিলের (৬৮)। তিনি বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করছি। দই-চিড়া-মুড়ির ভাসান দোকান করছি। গ্রামের হাটে হাটে ঘুরে সেসব বেচছি। এরপর ছোট্ট হোটেল করছি, তা-ও ৪০ বছর।’ জানালেন, তাঁর বাড়ি পটুয়াখালী সদরের বোতলবুনিয়া গ্রামে। চার মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এক মেয়ে বরিশালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করেন। একমাত্র ছেলে রবিউল পটুয়াখালী সরকারি কলেজে এখন স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন। রবিউলই মূলত বাবার সঙ্গে এখন পুরো ব্যবসা সামলান। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ ক্রেতা এই দোকানে খেতে আসেন। সবচেয়ে বেশি চাপ থাকে দুপুরে, বসতে দেওয়া মুশকিল হয়ে যায়।

আবদুল জলিলের ছেলে রবিউল বলেন, তাঁরা প্রতিদিন বাজার থেকে তাজা মাছ, মাংস, সবজি কিনে রান্না করেন। কোনো বাসি খাবার বিক্রি করেন না। তেল, মসলা কম ব্যবহার করেন। ক্রেতারা যাতে দেখতে পারেন তাঁরা যা খাচ্ছেন তা কেমন পরিবেশে, কীভাবে রান্না হচ্ছে, এ জন্য হোটেলের হেঁশেলকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তাঁর কথা, ‘আমাদের ব্যবসার মূলধন এটাই, বিশ্বস্ততা। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁরা এই বিশ্বস্ততা থেকেই আসেন। আবার ফিরেও যান তা নিয়ে। আর একটা লক্ষ্য থাকে আমাদের। সেটা হচ্ছে সামর্থ্য অনুযায়ী সব ক্রেতাই যেন এখানে এসে কম দামে খেতে পারেন।’