গরমে প্রাণ জুড়ায় বেড়ার ঐতিহ্যবাহী মাঠা
বৈশাখের তীব্র দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। প্রচণ্ড গরমে প্রাণ জুড়ায় পাবনার বেড়ার ঐতিহ্যবাহী মাঠা। সুস্বাদু পানীয় হিসেবে রোজাদারদের কাছে এর জুড়ি নেই। তাই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের পছন্দের শীর্ষে আছে ভেজালমুক্ত মাঠা।
মাঠা হলো একধরনের ঘোল, যা গরুর দুধ থেকে তৈরি হয়। তবে স্বাদে ও বর্ণে কিছুটা আলাদা। বাণিজ্যিকভাবে মাঠা তৈরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী ব্র্যান্ডগুলো। তবে স্থানীয় পর্যায়ে দেশের যেসব অঞ্চলে মাঠা তৈরি হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো পাবনার বেড়া উপজেলা। বেড়ায় প্রচুর গরুর দুধ উৎপাদিত হয় এবং মানের দিক দিয়ে এ এলাকার দুধের আলাদা সুনাম আছে।
স্থানীয় লোকজন মনে করেন, ভালো দুধের কারণেই এখানে ভালো মাঠা তৈরি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মাঠা তৈরির কারিগরদেরও আছে বিশেষ ভূমিকা। একসময় হাতে গোনা কয়েকজন ঘোষ মাঠা তৈরি করলেও এখন উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ জন ঘোষ মাঠা তৈরির সঙ্গে জড়িত। সারা বছরই তাঁরা মাঠা তৈরি করেন। তবে রমজান এলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মাঠা ব্যবসায়ীর সংখ্যাও বেড়ে যায়। বেড়ায় তৈরি মাঠা এখন উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জেলা-উপজেলা এবং রাজধানী ঢাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
মাঠা তৈরির সঙ্গে জড়িত ঘোষরা জানান, গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে মাঠা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় আগের দিন বিকেল থেকে। এরপর অনেকটা দইয়ের মতো করে সেই দুধ জমিয়ে রাত তিনটা থেকে চারটার মধ্যে শুরু হয় মাঠা তৈরির কাজ। জমাট বাধা সেই দইকে একটি বড় পাত্রে রেখে ব্লেন্ড করা হয়। স্থানীয়ভাবে এটিকে ‘টানা’ বলা হয়। এ কাজ বেশ পরিশ্রমের। সকাল সাতটার মধ্যেই বেশির ভাগ ঘোষের বাড়িতে তৈরি হয়ে যায় সুস্বাদু মাঠা। অনেকেই আগেভাগে ফ্রিজে রাখবেন বলে বা দূরের কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠাবেন বলে সকালেই ঘোষদের বাড়ি থেকে মাঠা কিনে থাকেন। তবে মাঠার মূল বিক্রি শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে। এ সময়ে মাঠা ব্যবসায়ীরা ভ্যানে মাঠা নিয়ে বেড়া বাজার, বেড়া বাসস্ট্যান্ড, হাটুরিয়া বাজার, নাকালিয়া বাজার, রাকশা বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। অনেকে আবার বাজারের বিভিন্ন স্থানে মাঠার পাত্র এনে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে বিক্রি শুরু করেন। বেলা দুইটা থেকে তিনটা বাজতে না বাজতেই বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর মাঠা শেষ হয়ে যায়। তাই বিকেলের অপেক্ষায় না থেকে লোকজন এ সময়ের মধ্যেই ভিড় করে মাঠা কেনেন। কোনো কোনো মাঠার দোকানের সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়েও মাঠা কিনতে দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাজারে ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১১০ টাকা লিটার দরে মাঠা বিক্রি হয়। মাঠা যত বেশি ঘন, এর দামও তত বেশি। এ ছাড়া বিশেষ কয়েক ঘোষের মাঠার আলাদা সুনাম রয়েছে। তাঁদের মাঠা বেশি দাম দিয়ে কিনতে লোকজন ভিড় করেন।
বেড়া পৌর এলাকার বনগ্রাম মহল্লার বিশু ঘোষ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে মাঠা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। তাঁর তৈরি মাঠার আলাদা সুনাম আছে। প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার লিটার মাঠা তৈরি করে বেড়া বাজারে রাস্তার পাশে বসে বিক্রি করেন তিনি। মানভেদে তিনি ৬০ থেকে ৮০ টাকা লিটার দরে মাঠা বিক্রি করেন।
বিশু ঘোষ বলেন, ‘এ এলাকায় আমিই মাঠাকে এতটা জনপ্রিয় করতে পেরেছি বলে আমার বিশ্বাস। একসময় অন্যরা মাঠা বানিয়ে আমার সঙ্গে টিকতে পারত না। কিন্তু এখন শুনি, অনেকেই মাঠা বানিয়ে বিক্রি করছেন। এমনকি বেড়ার অনেক অভিজাত হোটেলেও এখন মাঠা তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে।’
বেড়া বাজারে ভ্যানে ফেরি করে মাঠা বিক্রি করছিলেন মিলন ঘোষ। তিনি বলেন, ‘রমজান মাসে মাঠার চাহিদা এমনিতেই বেশি। এর ওপর প্রচণ্ড গরম পড়ায় চাহিদা আরও বেড়ে গেছে। আমি প্রতিদিন এক হাজার লিটার মাঠা নিয়ে হাটুরিয়া বাজার, বেড়া বাজার ও বেড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিক্রি করি। মাঠার চাহিদা এত বেড়েছে যে এর চেয়ে আরও ৫০০ লিটার বেশি বানালেও তা বিকেলের আগেই শেষ হয়ে যাবে।’
বেড়া বাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘প্রতি লিটার দুধের দাম ৫০ টাকা। অথচ ভালো মানের মাঠা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা লিটার দরে। কিন্তু আমরা এ দামে মাঠা কিনেও খুশি। কারণ, ইফতারে শীতল মাঠা দিয়ে বানানো শরবতের স্পর্শ ছাড়া মন ভরে না।’