‘গরু না পুষি দালাল হওয়ায় লাভ’

রংপুরের তারাগঞ্জে জমে উঠেছে কোরবানির গরুর হাট। গত শুক্রবার তারাগঞ্জ হাট থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলায় জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। কিন্তু হাটে দালালদের উৎপাতে ক্রেতা-বিক্রেতারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। দালালেরা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন ইচ্ছেমতো টাকা। বর্তমানে দালাল ছাড়া পশু কেনাবেচা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জে ৩৩টি হাটবাজার আছে। এর মধ্যে কোরবানির পশু বেচাকেনা হচ্ছে তারাগঞ্জ, ইকরচালী, ডাংগীর, বুড়ির, বদরগঞ্জ, পাঠানের, লালদীঘির, ট্যাক্সের ও ময়নাকুড়ি হাটে। এসব হাটে হাজারো গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া বেচাকেনা হয়। কিন্তু হাটে গরু, মহিষ, ছাগল কিনতে ও বিক্রি করতে আসা লোকজন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। দালালেরা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

কোরবানির হাটে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, গরু বা ছাগল ক্রয়-বিক্রয় করতে গেলে দালালদের শরণাপন্ন হতেই হবে। দালাল ছাড়া পশু কেনাবেচা অসম্ভব। কোনো ক্রেতা-বিক্রেতা তাঁদের শরণাপন্ন না হলে তুলনামূলক কম দামে পশু বেচতে এবং বেশি দামে কিনতে হয়। পশু হাটে নিয়ে আসার আগেই মালিকদের সঙ্গে তাঁদের দাম রফা হয়। রফা হওয়া দামের বেশি যে টাকা বিক্রি হবে, সে টাকা ওই দালাল নিয়ে নেন। এ ছাড়া হাটে পশু নিয়ে আসার পরও দাম–দর ঠিক করা হয়। আবার তাৎক্ষণিক ক্রেতার উপস্থিতিতেও সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে তাঁরা কমিশন ঠিক করে নেন।

তারাগঞ্জ হাটের দক্ষিণ দিকে গত শুক্রবার গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন পোদ্দারপাড়া গ্রামের হামিদুল ইসলাম। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তিনি একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। হামিদুল আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভাইজান মুই নিজের গরু নিজে বেচপার চাছনু, কিন্তু সারা দিন থাকিও একটা গরু বেচপার পানু না। দালাল না ধরায় মোর গরু বেচা হইল না।’

হামিদুলের পাশে গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাতাইপাড়া গ্রামের এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘ভাইজান দালালের কাছোত ক্রেতা-বিক্রেতা জিম্মি হয়ে পড়েছে। পশু কেনাবেচার ক্ষেত্রে দালালই ভরসা। ওই জন্য এক দালালোক ধরি ৭৫ হাজার টাকাত চুক্তি করি একটি গরু বেচপার দিছনু। গরু বেচাইছে ৮৩ হাজার মোক দিলে ৭৫ হাজার টাকা। বাকিটাক দালালে ভাগ করি নেইল।’

গত বৃহস্পতিবার বদরগঞ্জ হাটে কথা হয় গরু বিক্রি করতে আসা কাঁচাবাড়ি গ্রামের খামারি মাহাবুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সারা বছর গরু খামারোত পুষি যে লাভ হয় না। হাটোত সেই গরুর রশি ধরি হাতবদল করি দিলে তাঁর থাকি দ্বিগুণ লাভ হয় দালালের। হাটোত গরু কেনাবেচার লোকের চেয়ে দালালই বেশি। গরু না পুষি দালাল হওয়ায় লাভ।’

ওই হাটে কথা হয় ছাগল বিক্রি করতে আসা বৈরামপুর গ্রামের খোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘খালি গরু-ছাগল হাটোত নোয় মুরগির বাজারোত দালাল। দালালের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তবু প্রশাসনের লোক দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।’

তারাগঞ্জ বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, দালালেরা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে পশুর দাম নির্ধারণ করেন। যেমন চামটি ৪ হাজার, বন্নী ৫ হাজার, টিপি ৬ হাজার, ঝালী ৭ হাজার, কাটা ৮ হাজার, কুটাল ৯ হাজার, বননি ১০ হাজার, কালাই ১১ হাজার, বছর ১২ হাজার, ট্যাংগা ১৩ হাজার, মিটি ১৪ হাজার টাকা বোঝান। শুদ্ধ ভাষা না বলে তাঁরা নিজেদের তৈরি এসব ভাষায় কথা বলেন। পশুর হাটে গেলে এ ভাষা শোনা যায়। তাঁদের ভাষা গরুর ব্যবসায়ী ও দালাল ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারে না।

তারাগঞ্জ গরুর হাটে কথা হয় পাইকারপাড়া গ্রামের লোকমান হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবা, হামরা কিন্তু চুরি করি না। গরু আলাক কয় দাম ঠিক করি গরু বেচে দুই টাকা রোজগার করি। এতে দোষের কি? জোর করি তো কারও গরু নিয়া বেচাই না।’
জানতে চাইলে তারাগঞ্জ হাটের ইজারাদার স্বপন চৌধুরী মুঠোফোনে বলেন, সারা দেশের পশুর হাটে দালালেরা ছড়িয়ে পড়েছেন। তারাগঞ্জে থাকলে দোষ কি? দালাল থাকায় মানুষ দ্রুত পশু বিক্রি করতে পারে।

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুশান্ত কুমার সরকার বলেন, ‘দালালদের হাতে প্রতারিত হওয়ার কোনো অভিযোগ এখনো পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’