গুমোট আবহাওয়া, অসহনীয় তাপপ্রবাহ বাড়াচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক
দক্ষিণ উপকূলে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অধিক তাপপ্রবাহ আর গুমোট আবহাওয়া মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অসহনীয় করে তুলেছে। মে মাসের এ অসহ্য তাপপ্রবাহ বাড়াচ্ছে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে উপকূলের প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, স্বাধীনতার আগে থেকে মে মাসেই দেশের উপকূলে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত হেনেছে। আবার বড় বড় যত ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, তার সপ্তাহখানেক আগে তাপমাত্রা অসহনীয় থাকে। এবারও সে রকমই প্রখর তাপ অনুভূত হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদেরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলছেন, পূর্ব–মধ্য বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ তৈরি হয়েছে। এটি নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ঘূর্ণিঝড় আকারে ২৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলবর্তী এলাকায় আছড়ে পড়তে পারে। এ ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছে ইয়াস।
আবহাওয়া বিভাগ বলছে, গত শুক্রবার শনাক্ত হওয়া লঘুচাপটি শনিবার সুস্পষ্ট লঘুচাপে রূপ নেয়। আর রোববার দুপুর ১২টায় এটি নিম্নচাপে পরিণত হয়। সেটি দুপুর ১২টায় আরও ঘনীভূত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৬২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা থেকে ৭১০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা বন্দর থেকে ৬৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে গভীর নিম্নচাপ এবং পরে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বরিশাল নগরের রুপাতলী এলাকায় আজ রোববার দুপুরে কথা হয় রিকশাচালক আবুল কালামের (৫৫) সঙ্গে। তাঁর চারজনের সংসার চলে রিকশা চালিয়ে। আবুল কালাম বলেন, সকালে বের হয়ে বেলা ১১টা পর্যন্ত রিকশা চালাতে পারছেন না। গরমে দম আটকে যাচ্ছে, প্যাডেল ঘোরাতে পারছেন না। এ রকম গরম তিনি আগে ‘ফেস’ করেননি।
নিম্নচাপের প্রভাবে ১৫ মে থেকে বরিশাল অঞ্চলে একটানা মৃদু ও মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। সূর্যের প্রখর তেজ আর তীব্র দাবদাহে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দিনের এ প্রখর খরতাপ অক্ষুণ্ন থাকছে রাতে। আবহাওয়া বিভাগের হিসাবে, ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রাকে মৃদু এবং ৩৮ ডিগ্রির ওপরের তাপমাত্রাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বলা হয়।
বরিশাল আবহাওয়া বিভাগের তথ্য বলছে, রোববার বরিশাল অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন ছিল ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি। ১৫ মে থেকে এ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রির নিচে নামেনি। তবে অনুভূত তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি। এ বছর বরিশাল অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল এপ্রিলে ৩৯ ডিগ্রি। তবে ওই সময় এত গরম অনুভূত হয়নি।
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকা বরগুনার তালতলী উপজেলার মোমেপাড়া গ্রাম। এ গ্রামের বাসিন্দা রোস্তম আলীর বয়স পেরিয়েছে ৭৫ বছর। আবহাওয়ার অবস্থার বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়সহ বড় বড় ঝড়ের আগে এমন অসহনীয় গরম দেখা যায়। প্রতিটি ঝড়ের আগে তাপ বৃদ্ধি পায়। আবহাওয়ার যে অবস্থা, তাতে তাঁরা শঙ্কিত।
বরিশাল আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান রোববার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, নিম্নচাপের কারণে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা অসহনীয়ভাবে অনুভূত হচ্ছে। প্রচুর ঘাম হচ্ছে এবং সবকিছু অসহনীয় লাগছে। সেমাবার সকাল থেকে তাপের এ দাপট কিছুটা কমতে পারে এবং আকাশ মেঘলা হতে পারে। বিকেলে সামান্য বৃষ্টিও হতে পারে।
মে মাসের যত ঘূর্ণিঝড়
গত বছর ২০ মে বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। আম্পান আঘাত হানার চার দিন আগে গেল বছরের ১৬ মে আবহাওয়া বিভাগ নিশ্চিত করেছিল এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানতে পারে। ঠিক সেটাই হয়েছিল। ২০ মে বিধ্বংসীরূপে আম্পান তাণ্ডব চালায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর ওপর।
এর আগের বছর ২০১৯ সালের ১২ মে এ অঞ্চলে আঘাত হানে আরেক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ফণী। এর তাণ্ডবে পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে মোট ৮৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ মে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোরা ১৪৬ কিলোমিটার বাতাসের গতিতে উপকূলে আঘাত হানে। ঝড়ের তাণ্ডবে হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। দুজন নারীসহ তিনজন মারা যান।
২০১৬ সালের ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতে আংশিক অঞ্চলে আঘাত হানে ছোট মাত্রার আরেক ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। ধারণা করা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির। রোয়ানুর আঘাতে চট্টগ্রামে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০১৩ সালের ১৬ মে এ অঞ্চলে আঘাত হানে আরেক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় মহাসেন। ২০০৯ সালে ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। এ ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।
এরও আগে ২০০৮ সালের ৩ মে মিয়ানমারে আঘাত হানে আরেক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় নার্গিস। এর তাণ্ডবে সেখানে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষ। এর গভীর আঁচ লাগে বাংলাদেশের উপকূলেও। ১৯৯৭ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে। ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়।
১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন।