স্রোতের তোড়ে বসতঘর ভেসে যাওয়ার আতঙ্কে চর দলিকার কিছু লোক এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি।
তাঁরা ঘর পাহারা দিচ্ছেন।
এক পাশে উত্তাল যমুনা নদী। অন্য পাশে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কাজলা ও কালির চর। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি বসতঘর। ঘরের ভেতর, আঙিনায় বইছে পানির স্রোত। তলিয়ে যাওয়া নলকূপের অর্ধেক অংশ এখনো পানির নিচে। ডুবে আছে কাঁচা শৌচাগার। অর্ধেক ডুবে থাকা একটি বসতঘরে দরজায় গাছের লতাপাতা বেঁধে যমুনার স্রোতের থেকে তা রক্ষার নিরন্তর চেষ্টা করছেন আবদুল শেখ।
আবদুল এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ঠিকমতো কাজও করতে পারেন না। আট দিন ধরে পানিবন্দী। পরিবারের সদস্যদের রেখে এসেছেন পাশের আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে নিজে সেখানে যাননি। স্রোতের তোড়ে বসতঘর ভেসে যাওয়ার আতঙ্কে বুকসমান পানিতে নেমে কখনো আঙিনায়, কখনো উঠানে দাঁড়িয়ে ঘর বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
বগুড়া থেকে সারিয়াকান্দির কালিতলা ঘাটের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উজানে প্রায় ৩০ কিলোমিটার যমুনা নদীর দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার পর দেখা মিলে চর দলিকার। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে কথা হয় আবদুল শেখের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘গেলবার এক মাস জলত ভাসনু। এক ছটাক ইলিপ (ত্রাণ) কপালে জুটল না। বানের ঢলে ভাঙা ঘর মেরামত করতে না করতে এইবারের বানের ঢলের হানা। ঘরডা ভাঙার সময় দেয়নি। আট দিন থ্যাকে বানত ভাসিচ্চি। ঘরের ভিতর এক বুক পানি। ঘরের মায়ায় পানিত ভাসিচ্চি। বানের ঢল ঘরত ঢুকিচ্চে। কখন বুঝি ঘরডা খ্যাপা যমুনা ভাসে লিয়ে যায়, এই ভয়ে আচি। নির্ঘুম রাত কাটাচ্চি। দরজা বান্দিবার অ্যাকনা দড়িও নাই। লতাপাতা দিয়ে ঘরের দরজা বান্দে রাখচি।’
গতকাল দুপুরে যমুনা নদীতে পানি কমতে শুরু করলেও এখনো অর্ধেক বসতঘর কোমরপানিতে তলিয়ে আছে। চরের আজিজার শেখ বলেন, আট বিঘা জমির পাটের খেত আর তিন বিঘার আউশ ধান বন্যার পানিতে শেষ। এখন বসতভিটাও হুমকিতে। তিন দিন ধরে কিছু খাননি। ত্রাণও জোটেনি।
স্রোতের তোড়ে কাবু আমির শেখ (৬০) বন্যা প্লাবিত বসতঘর ফেলে আশ্রয় নিয়েছেন চর দলিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে ঠাঁই হয়েছে তাঁর মতো বানভাসি আরও ৩০-৩৫টি পরিবারের। আমির শেখ বলেন, ‘আট দিন ধরে জলের সঙ্গে লড়াই করিচ্চি। একবেলা ভাত, আরেকবেলা বিস্কুট-মুড়ি খ্যায়া জীবন বাঁচাচ্চি । প্রশাসন-মিম্বার চিয়ারম্যান কেউ চরত খোঁজ লিবার আসেনি।’
শাহজাহান শেখ বলেন, সাংসারিক কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। ৩০ পরিবারের শতাধিক সদস্য আছেন। টিউবওয়েল আছে মাত্র একটি। নেই পর্যাপ্ত শৌচাগার। ঘরে চাল থাকলেও রান্না করার মতো অবস্থা নেই। জ্বালানি–সংকটে চুলা ধরানো যাচ্ছে না।
জলে ভাসা বসতঘরে রূপালি বেগম এক মাসের দুধের শিশু নিয়ে তিন দিন আটকা ছিলেন। পরে ওঠেন আশ্রয়কেন্দ্রে। রূপালি বলেন, ‘মিচ্চি অ্যানা স্কুল ঘরত গাদাগাদি করে ১০০ লোকের বাস। অ্যাকনা কল থ্যাকে লাইন ধরে খাবার পানি সংগ্রহ করা লাগে। সকালে লাইন ধরে বাথরুম সাড়া লাগে। ছোট ছল লিয়ে খুব কষ্ট হয়।’
আরেক ভুক্তভোগী আরজিনা বেগম বলেন, ‘ইলিপ নাই, খাবার নাই, পানি নাই। লিজের খিদা সহ্য হয়। অবুঝ ছলডার খিদা সহ্য করি ক্যাংকা করে?’
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, পানি কমতে শুরু করলেও এখনো যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে। গতকাল দুপুর ১২টায় সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বলেন, গতকাল পর্যন্ত সারিয়াকান্দিসহ ৩ উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের ৭৮ হাজার ৪৪৮ মানুষ (১৬ হাজার ৭৮০ পরিবার) পানিবন্দী রয়েছেন। বন্যায় প্রাণহানি হয়েছে একজনের। তিন উপজেলায় ১০০ মেট্রিক টন চাল ও ১৫ লাখ টাকা ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ত্রাণ বিতরণ শুরু
সিরাজগঞ্জে নদীর পানি দ্রুতগতিতে কমতে শুরু করেছে। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত যমুনার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছিল। পাউবোর গেজ রিডার (পানি পরিমাপক) হাসানুর রহমান বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট এলাকায় যমুনার পানি রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫২ মিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৬ সেন্টিমিটার কমে এখনো যমুনার পানি বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমতে থাকায় শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার নদীভাঙন অনেকটা কমেছে।
জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের জন্য ১৪০ মেট্রিক টন চাল, ২ লাখ টাকা ও ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া মজুত রাখা হয়েছে ৭৭১ মেট্রিক টন চাল ও ১৪ লাখ টাকা। প্রয়োজনে আরও বরাদ্দ দেওয়া হবে।