‘ঘর ভাঙি গেছে, এখন খানি নাই, কাপড় নাই’

বন্যার পানিতে গ্রামের ভেতরের রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় ভেলায় চড়ে ঘরে ফিরছেন একজন। গতকাল সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের শিমুলতলা গুচ্ছগ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

পিয়াইন নদের পারের ছোট একটি গ্রাম শিমুলতলা। সেখানে স্বামী–সন্তান নিয়ে বাস করেন সুখেরা খাতুন। নদী ঘেঁষেই বাড়ি তাঁদের। দূর থেকে দেখছিলাম ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন বয়স ৪০ পেরোনো সুখেরা। উঠানের হাঁটুপানি ডিঙিয়ে কাছে যেতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘সুখ-শান্তি সব শ্যাষ আমার। চালের উপর দিয়া বানের পানি গেছে। ঘর ভাঙি গেছে। জিনিসপত্র ভাসি গেছে। এখন খানি (খাওয়া) নাই, কাপড় নাই।’

গত ১৫ জুন সন্ধ্যার বানের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ঘরের সামনেই স্বামীর ছোট্ট দোকান। হঠাৎ শান্ত পিয়াইন অশান্ত হতে শুরু করে। হু হু করে পানি বাড়ে। চোখের পলকে ঘর–দোকান সব বুকসমান পানিতে ভেসে যায়। স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে কোনোরকমে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেন। গত শুক্রবার আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে ঘরে ফিরেছেন। এসে বিধ্বস্ত ঘর ছাড়া আর কিছুই পাননি।

গতকাল শনিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, শিমুলতলার ১৩২টি ঘর কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরগুলো থেকে পানি নেমেছে। কিন্তু বারান্দা–উঠানে এখনো পানি আছে। কোনো কোনো ঘর ধসে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে আছে। হেলে পড়েছে উঠানের গাছপালা। পানিতে ভাসছে বন্যায় মারা যাওয়া একটি ছাগল।

বন্যার পানিতে শিমুলতলা গুচ্ছগ্রামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গ্রামটি বেশ নিচু। তাই স্থানীয় মানুষ বারবার ভোগান্তিতে পড়েন। পানি নেমে গেলে গ্রামটিতে মাটি ফেলে উঁচু করে প্রতিটি ঘর পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
লুসিকান্ত হাজংয়ের, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)

শিমুলতলার কৃষক হাসান আলী (৬৫) বলেন, ‘বারোডা গরু-বাছুর আছিল আমার। এর মইধ্যে তিনটা গরু ভাসি গেছে। তিনটা মেরাও (ভেড়া) ভাসি গেছে। এখন ঘরে ফিইরা দেখি ডেগ-ডেচকি, কাপড়চোপড় সব ভাসি গেছে। যা অবশিষ্ট আছে, তাই গুছাইতাছি। এমন পানি বাপের জন্মেও দেখছি না।’

কোম্পানীগঞ্জের পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের শিমুলতলায় ২০০০ সাল থেকে বসতি শুরু হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখানে ভূমিহীনদের ঘর করে দেওয়া হয়েছে। তাই স্থানীয়রা একে গুচ্ছগ্রাম নামে চেনেন। বেশির ভাগ গ্রামবাসী পেশায় দিনমজুর। অবস্থান নদীর তীরবর্তী নিচু এলাকায় হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই গ্রামটি বারবার তলিয়ে যায়। চলতি বছর তিন দফায় ডুবেছে গ্রামটি। তবে গত জুনের বন্যার ভয়াবহতা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বন্যার পর তাঁরা ত্রাণসহায়তা পেয়েছেন। তবে হাতে নগদ অর্থ না থাকায় তাঁরা ভাঙাচোরা ঘর মেরামত করতে পারছেন না।

‘আফালে-বানালে শ্যাষ’

শিমুলতলার বাসিন্দা ইদ্রিস মিয়া (৬০) পেশায় দিনমজুর। চোখে পানি নেই, তবু তাঁর কণ্ঠ যেন ধরে আসছিল। তিনি বলেন, ‘আফালে (ঢেউ) আর বানালে (তুফান) শ্যাষ অই যাইয়ার। কুনুরকমে জান নিয়া ঘর ছাড়ছি। ঘরের শক্ত কিছু জিনিস ছাড়া সব ভাইসা গেছে। যে কয়েকটা শক্ত জিনিস (আসবাব) আছে, সেইগুলাও পইচা গেছে।’

পাশ থেকে ফখরুল ইসলাম (৩০) বলেন, ‘গ্রামের সব ঘর আফালে ভাঙছে। আমার ঘরও ডুবছে, উপজেলা সদরের দোকানও ডুবছে। এখন চলার পথ দেখতাছি না। বন্যার তিন দিন আগে আমার একটা ছেলে হইছে। মা-পুতরে আরেক জায়গায় রাখছি। এখন টিইক্যা থাকার লাগি একটা এনজিও থাকি ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। ঋণের টাকা কেমনে দিমু, সেইটাও ভাইবা কূলকিনারা পাইতাছি না।’

ভরসা বালুর স্তূপ

শিমুলতলা গ্রামের পাশেই রয়েছে পাহাড়ের মতো উঁচু বিশাল বালুর স্তূপ। এক ব্যবসায়ী বিক্রির জন্য এই বালু স্তূপ করে রেখেছেন। গ্রামটি যখন এক রাতে তলিয়ে যায়, তখন অন্তত ৬০টি পরিবার ওই রাত ও পরদিন সকালে এই বালুর স্তূপে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায়। শুধু তাই নয়, অনেকে এখন ওই বালুর স্তূপে পলিথিন, বাঁশ, টিন দিয়ে ছাপরা বানিয়ে বাস করছেন।

গতকাল গিয়ে দেখা যায়, বালুর স্তূপের চারপাশে পানি আর পানি। স্তূপটি যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো ভেসে আছে। ছাপরায় বসে রয়েছেন আশ্রয় নেওয়া মানুষের অনেকেই। পাশেই রয়েছে গরু–ছাগল। নৌকা ভিড়তেই অনেকে এসে ভিড় জমালেন। ভেবেছেন, ত্রাণ দিতে কেউ এসেছে হয়তো। জানালেন, বন্যার পর ত্রাণ পেয়েছেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।

বালুর স্তূপে আশ্রয় নেওয়া শিশুরা পানিবাহিত নানা রোগে ভুগছে। অনেকের শরীরে পাঁচড়া, কানে পুঁজ, ডায়রিয়া আর জ্বর দেখা দিয়েছে। মধুমালা বেগম (২২) জানালেন, তাঁর তিন সন্তান। সবচেয়ে ছোটটির বয়স ৯ মাস। তিন দিন ধরে শিশুটির ডায়রিয়া। সপ্তাহখানেক আগে একবার এই বালুর স্তূপে সরকারি চিকিৎসক এসেছিলেন। পরে আর আসেননি। হাতে টাকাও নেই। তাই সন্তানকে চিকিৎসক দেখাতে পারছেন না।

শিমুলতলা ঘরে এসে কথা হলো কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজংয়ের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বন্যার পানিতে শিমুলতলা গুচ্ছগ্রামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গ্রামটি বেশ নিচু। তাই স্থানীয় মানুষ বারবার ভোগান্তিতে পড়েন। পানি নেমে গেলে গ্রামটিতে মাটি ফেলে উঁচু করে প্রতিটি ঘর পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।