চা-বাগানে ‘ঊষার’ আলো

শিশুদের বিনে পয়সায় গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা শেখান নিগাত সাদিয়া। ম্যারাথনের প্রশিক্ষণও দেন। চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থাও আছে।

বছর পাঁচেক ধরে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ঊষা’র উদ্যোক্তা নিগাত সাদিয়া। সম্প্রতি সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানের ক্লাব লাইন টিলায়
ছবি: আনিস মাহমুদ

‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল...’। গাছগাছালি ঘেরা সবুজ চা-বাগানের ভেতরের এক টিলা থেকে ভেসে আসছে সমবেত কণ্ঠের গান। উৎস জানতে গিয়ে দেখা গেল, এক বাড়ির উঠানে কয়েকখানি পাটি বিছিয়ে সেখানে বসে জনা চল্লিশেক শিশু, কিশোর-কিশোরী গান গাইছে। তাদের সুর ও গায়কির ভুলত্রুটি পাশে বসে শুধরে দিচ্ছিলেন ‘গান-দিদিমণি’।

সম্প্রতি এক বিকেলে সিলেট শহরতলীর লাক্কাতুরা চা–বাগানের ক্লাব লাইন টিলায় গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেল। ‘ঊষা’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চা-শ্রমিকদের সন্তানদের বিনে পয়সায় গান, ছবি আঁকা, আবৃত্তি, মৃৎশিল্প, বইপড়া, নৃত্য, অভিনয় শেখাচ্ছে। এর উদ্যোক্তা নিগাত সাদিয়া (৩৭)। বছর পাঁচেক ধরে দুর্গম এলাকায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। ৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের শুক্র ও শনিবার বিভিন্ন বিষয়ে পড়ান ও প্রশিক্ষণ দেন সাদিয়া। ম্যারাথন দৌড়ের প্রশিক্ষণও দেন। শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার গড়েছেন। নিয়মিত বিরতিতে শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনীরও আয়োজন করেন।

চা-বাগানে যে হীনতার গল্প আছে, এর পরিবর্তন ঘটাতেই নিগাত সাদিয়া কাজ করছেন। ঊষা একটা ছোট্ট উদ্যোগ। কিন্তু এটা বিস্তৃত হতে পারে সবার সহযোগিতায়।
আশরাফ শিশির, উপদেষ্টা, উষা ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক

নিগাত সাদিয়ার বাড়ি সিলেটের জৈন্তাপুরে। ২০০৯ সালে বিয়ের পর সিলেট নগরের শিবগঞ্জ এলাকায় বসবাস শুরু করেন। স্বামী ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। সমাজকর্মে স্নাতকোত্তর শেষ করে একসময় ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিলেন। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তবে কিছু একটা করার তাড়না তাঁর মধ্যে সব সময়ই ছিল। এর অংশ হিসেবেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন সাদিয়া। ২০১৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ঊষা’।

সাদিয়া জানান, চা-বাগানের শ্রমিকদের বাড়ির উঠান এবং চা-বাগানের টিলায় সহশিক্ষা কার্যক্রমের ক্লাস এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে শ খানেক শিশু ঊষায় যুক্ত আছে। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই লাক্কাতুরা ও মালনীছড়া চা-বাগানের শ্রমিকদের সন্তান। বাকিরা শহরের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসা সহায়তাও দেওয়া হয়। শিশুদের পাঠাভ্যাস তৈরিতে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারে রাখা হয়েছে পাঁচ শতাধিক বই। এ কাজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও গ্রো ইউর রিডারের সহযোগিতাও রয়েছে।

বিভিন্ন বিষয়ে শিশু–কিশোরদের প্রশিক্ষণ দিতে আটজন প্রশিক্ষক আছেন ঊষায়। কোনোরকম সম্মানী ছাড়াই তাঁরাও শিশুদের শেখান। মূলত বিভিন্ন মানুষের আর্থিক সহায়তা ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে চলে সংগঠনটি। সংগঠনের ১৪ সদস্যের উপদেষ্টা ও পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে।

নিগাত সাদিয়া

উষা’র উপদেষ্টা হিসেবে আছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক আশরাফ শিশির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চা-বাগানে যে হীনতার গল্প আছে, এর পরিবর্তন ঘটাতেই নিগাত সাদিয়া কাজ করছেন। ঊষা একটা ছোট্ট উদ্যোগ। কিন্তু এটা বিস্তৃত হতে পারে সবার সহযোগিতায়।

চা–শ্রমিকদের সন্তানদের বিনে পয়সায় গান শেখান সিলেটের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী পল্লবী দাশ। তিনি জানান, জীবনে যা শিখেছেন, সেটা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সন্তানদের বিলিয়ে দিতে পারছেন, এটাই তাঁর কাছে আনন্দের।

গত রোববার বিকেলে লাক্কাতুরা চা-বাগানে গিয়ে কথা হয় শিশুদের সঙ্গে। চৈতী গোয়ালা জানায়, সে সৈয়দ নাসির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। তার মা–বাবা চা-শ্রমিক। গান, নৃত্য ও আঁকায় তার আগ্রহ। কয়েক বছর ধরে এখানে এসে নিয়মিত সহশিক্ষার পাঠ নিচ্ছে।

মিতা গোয়ালাও এবার গ্রিন সিটি ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি দেবে। চা–বাগানের আশপাশে কোনো
গ্রন্থাগার নেই। গল্প-উপন্যাস পড়তে ঊষার এই গ্রন্থাগারই তার ভরসা।

১০ কিলোমিটারের মিনি ম্যারাথনে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে উপশহর শাহীন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী আফসানা হালিমা। সে বলল, এখানে ভর্তি হয়ে সপ্তাহে ৫ দিন সে ম্যারাথন দৌড়ের প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। তার মতো আরও তিনজন সাদিয়ার কাছ থেকে ম্যারাথনের প্রশিক্ষণ নেয়।

ঊষার প্রতিষ্ঠাতা নিগাত সাদিয়া নিজেও ম্যারাথনে অংশ নেন। তিনি বললেন, চা-বাগানগুলোতে শোষণ, বঞ্চনা, গ্লানি, রোগ, শোক ও বৈষম্যের আঁধার তাড়িয়ে একটা নতুন সূর্যোদয়ের আশাতেই ‘ঊষার’ জন্ম। বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনের পাশাপাশি শিক্ষা সফরসহ উৎসবকেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠানও তারা পালন করেন বলে জানালেন। এতে চা-বাগানের শিশুরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে, সংবেদনশীল ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে।