চা বেচে সংসার চালায় ১০ বছরের আবদুল্লাহ

চা বেচে দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় করে আবদুল্লাহ
ছবি: প্রথম আলো

শহরের রাজবাড়ী সড়কের ‘ভান্ডারির’ দোকানের সামনে তখন জমজমাট আড্ডা। বিভিন্ন বয়সের প্রায় ২০ জন সেখানে আড্ডায় মেতেছেন। কারও হাতে চা, কেউবা চায়ের অপেক্ষায়। হঠাৎ সে আড্ডায় উপস্থিত হলো ছোট্ট একটি শিশু, নাম আবদুল্লাহ (১০), হাতে চায়ের বড় ফ্লাস্ক। ঘামে ভেজা শরীরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।

একটু দূর থেকে আড্ডার একজনকে উদ্দেশ করে আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করল, ‘আংকেল, কয়টা বাজে?’। তবে আবদুল্লাহর ডাক ওই ব্যক্তির কানে পৌঁছাল না। এরপর আবদুল্লাহ আরেকটু কাছে গিয়ে, আরেকটু উঁচু গলায় ‘ও আংকেল! কয়টা বাজে?’ এবার ওই ব্যক্তি প্যান্টের পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে জানালেন, ‘১০টা ৩৫ মিনিট (রাত)।’ এরপর কিছু একটা চিন্তা করে আবদুল্লাহ আবার হাঁটা শুরু করল।

আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গেলাম। সে বলল, ‘এহনো পাঁচ–ছয় কাপ চা বেচা বাকি। দেহি ওদিক (রাজবাড়ী মাঠ) যাইয়্যা বেচন যায় কি না। পুরা চা শেষ না হইলে মা মন খারাপ করব।’ কথা বলতে বলতেই দুই তরুণ আবদুল্লাহর কাছে চা চাইল। এই ফাঁকে আবদুল্লাহর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার সুযোগ পাওয়া গেল।

আবদুল্লাহ জানাল, তারা মোট আট ভাইবোন। এর মধ্যে বর্তমানে ছয়জন বেঁচে আছে। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। প্রায় এক বছর আগে ঝগড়া করে আবদুল্লাহর মা–বাবা আলাদা হয়ে যান। তখন থেকে আবদুল্লাহসহ চার ভাইবোন মায়ের সঙ্গে নগরের কাজীবাড়ি এলাকার ভাড়া বাসায় থাকে।

আবদুল্লাহ বলে, ‘মা মাইনষের বাসায় ভিক্ষা কইর‍্যা যে চাইল পায়, হেইড্যা দিয়া হয় না। হেললাইগ্যা আমার বড় বোন ও আমি কাজ করি। আমি যেই ট্যাকা পাই, হেইড্যার পুড়াডাই মারে দেই। মা এই ট্যাকা দিয়া বাজার করে।’

ছোট্ট এই টিনের ঘরেই আবদুল্লাহদের থাকা–খাওয়া–ঘুম
ছবি: প্রথম আলো

আবদুল্লাহর গ্রামের বাড়ি শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায়। তবে গত বছর আবদুল্লাহর বাবা রতন ঝগড়া করে শেরপুরে চলে গেছেন। এর পর থেকেই আবদুল্লাহর জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছে।

আবদুল্লাহ বলে, ‘বাবা আছিল, আমাগোর কোনো কষ্টই আছিল না। বাবা কাজ করত, আমরা ভাই–বোনেরা লেখাপড়া করতাম। কিন্তু বাবা চইল্যা যাওয়ার পর মা একা হইয়্যা যায়। কোনোভাবেই সংসার চালাতে পারছিল না। হেইলাইগ্যা লেখাপড়া বাদ দিয়া পরে আমরাও কাজ শুরু করি।’

আবদুল্লাহ প্রতিদিন দুপুরে ফ্লাস্কে চা ও একটি ব্যাগে কিছু ওয়ানটাইম কাপ নিয়ে বের হয়। চা বেচে দিনে তার আয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। চা–বিক্রির পুরো টাকাই সে তুলে দেয় তার মায়ের হাতে। এর মধ্যে কোনো দিন বিক্রি কম হলে আবদুল্লাহর মা মন খারাপ করেন।

গত মঙ্গলবার রাতে আবদুল্লাহর সঙ্গে এতটুকুই কথা হয়। এরপর সরেজমিনে দেখতে পরদিন বুধবার রাতে আবদুল্লাহর বাসায় গেলাম। কাজীবাড়ি এলাকার আবুসাঈদের বস্তিতে তাদের বাসা। ছোট্ট টিনের ঘর। এ ঘরেই থাকা–খাওয়া–ঘুম। মা উরবিনা বেগম সারা দিন ভিক্ষা করে জোগাড় করা চাল কুলায় তুলে ঝাড়ছিলেন। পাশেই মেঝেতে ঘুমাচ্ছিল তাঁর বড় মেয়ে নাসিমা এবং ছোট দুই ছেলে তারিফ ও রবিন। আবদুল্লাহ তখনো চা–বিক্রি শেষে বাসায় ফেরেনি। আবদুল্লাহর মা উরবিনা ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

উরবিনা বেগম বলেন, প্রায় এক বছর ধরে এখানে ভাড়া থাকেন তিনি। স্বামী রতন মিয়াও ছিল তাঁদের সঙ্গে। তখন দুজনের আয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল সংসার। আবদুল্লাহ ও নাসিমা তখন স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ত। কিন্তু এর মধ্যে পারিবারিক কলহে রতন মিয়া তাঁদেরকে ফেলে গ্রামে চলে যান। সেই থেকে তিনি সংসার চালাচ্ছেন। কিন্তু এখন তিনিও অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারেন না বলে বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করছেন। কিন্তু তাতেও সংসার চলে না। তাই দুই ছেলেমেয়েকে কাজে পাঠিয়েছেন।

উরবিনা বলেন, ‘মানুষের কাছ থ্যাইক্যা আমি যা পাই, তা দিয়া খাওন চালাইয়্যা ঘরভাড়াই দিতে পারি না। প্রতি মাসেই মানুষের কাছে হাত পাততে অয়। এর মধ্যে পোলায় চা বেইচা যে ট্যাকা আনে, তা দিয়া বাজার করি। আর কিছু ট্যাকা ঘরভাড়ার লাইগ্যা জমাই। ইচ্ছা ছিল পোলামাইয়্যাগুলারে লেখাপড়া করামু। কিন্তু আমরা তো তিন বেলার ভাতই জোগাড় করতে পারি না।’