ছোটখাটো বাজার থেকে আলোকিত এক নগর

সময়ের পরিক্রমায় শহর সিলেট বড় হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু অনেকটাই হারিয়ে গেছে পাহাড় আর বন। সম্প্রতি সিলেটের জিন্দাবাজার এলাকার চিত্র
ছবি: আনিস মাহমুদ

‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শহর কোনটা?’—এমন প্রশ্ন রেখেছিলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কিছু শৈশব (২০০৭) বইয়ে। পরে নিজেই উত্তর দিয়েছিলেন এভাবে, ‘অবশ্যই সিলেট শহর। শৈশবে তাই মনে করতাম, এখনো করি। সিলেটে যতবার যাই, শান্তি শান্তি ভাব হয়।’ আমৃত্যু এটাই ছিল হুমায়ূনের বিশ্বাস।

কেবল হুমায়ূন আহমেদ কেন, তাঁর আগে-পরে অনেক মনীষীই সিলেটের সৌন্দর্য ও নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেছেন। পর্যটক ইবনে বতুতা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সুভাষচন্দ্র বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকেই এই শহরে এসেছেন এবং নিজেদের মুগ্ধতার কথাও জানিয়েছেন।

গবেষকেরা বলছেন, বহু প্রাচীন জনপদ হিসেবে বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজে শ্রীহট্ট, সিলাহট, শিলহট, সিরহট বা সিলহট নামের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও শহর হিসেবে সিলেটের গোড়াপত্তনের খুব বেশি তথ্য মেলে না। অনেকে সিলেট শহরের প্রাচীনত্ব ৭০০ বছরেরও বেশি সময় বলে মনে করে থাকেন। তবে ১৩০৩ সালে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সিলেট আগমনের মধ্য দিয়ে সিলেট শহর দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া শুরু করে। সে ধারাবাহিকতায় আলোকিত এক শহর হিসেবেই আলাদাভাবে পরিচিতি আদায় করে নিয়েছে সিলেট।

স্কটল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট লিন্ডসে ১৭৭৮ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত সিলেটের কালেক্টর পদে ছিলেন। আত্মজীবনী ওরিয়েন্টাল মিসচেলানিজ: অ্যানেকডোট অব ইন্ডিয়ান লাইফ-এ তিনি সিলেট নিয়ে লিখেছেন, ‘শহর তখন ছোটখাটো বাজারমাত্র ছিল। অধিবাসীদের গৃহ ছিল পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ও বনজঙ্গলের আড়ালে ঢাকা।’

লিন্ডসের দেখা সেই ‘ছোটখাটো বাজার’ ঠিক এক শ বছর পর (১৮৭৮ সালে) পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়। এর ১২৪ বছর পর ২০০২ সালের ২৮ জুলাই পৌরসভাটি সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। এই রূপান্তরে সিলেট বড় হয়েছে, এর উন্নয়ন হয়েছে নানাভাবে; কিন্তু অনেকটাই হারিয়ে গেছে লিন্ডসের দেখা পাহাড় আর বন।

সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইটে বলা আছে, ১৭৭২ সালের ১৭ মার্চ সিলেট জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলেই সিলেট দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক মারাত্মক ভূমিকম্প গোটা শহরটিকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তী সময়ে ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে ওঠে ইউরোপীয় ধাঁচের আরও সুন্দর ও আধুনিক শহর।

একই ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়েছে, ১৮৯০ সালের শেষ ভাগে বেশ কিছু রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়। ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটি শাখা সিলেটের সঙ্গে সংযুক্ত হলে দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সিলেটের বিচ্ছিন্নতার প্রকৃত অবসান ঘটে। চা-শিল্পের কারণে বিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে সিলেট শহরে দ্রুত নগরায়ণ ঘটতে থাকে।

মদনমোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও গবেষক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ ‘শহর সিলেটের ৭০০ বছর’ শিরোনামে একটা লেখা বেশ আগে লিখেছেন। সেই সূত্র ধরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কিছু তাম্রলিপি ও শিলালিপির আলোকে বলা যায়, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে চতুর্দশ শতাব্দীর পূর্বভাগ এবং তৎপরবর্তী শাহজালালের আগমন ও ঔপনিবেশিক আমলে সিলেট তথা সিলেট শহরের নাগরিক জীবন নানাভাবে আলোড়িত ছিল এবং আছে। ঐতিহাসিক কালপ্রবাহে এর প্রাচীনত্ব ৭০০ বছরেরও অধিক।

সিলেট শহরবিষয়ক মুদ্রিত নানা বই এবং দলিলপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, ১৮১৫ সাল পর্যন্ত সিলেট শহরের আয়তন ছিল মাত্র ৪ বর্গকিলোমিটার। ধীরে ধীরে এর পরিসর বাড়ে। ১৯৩১ সালে সিলেট শহরের রাস্তায় প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে। ১৯৩৯ সালে সিলেটে প্রথম সাইকেল রিকশা আসে। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সক্রিয়।

বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি কর্তৃক শরীফ উদ্দিন আহমেদের সম্পাদনায় সিলেট: ইতিহাস ও ঐতিহ্য (১৯৯৯) নামের একটা বই প্রকাশিত হয়। এতে শরীফ উদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ‘১৭৬৫ সালে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে সিলেট শহরের ইতিহাসে ঔপনিবেশিক যুগের সূচনা হয়। ...প্রশাসনিক, শিক্ষা এবং অন্যান্য পেশাগত ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে সাথে সিলেট শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যভিত্তিক কর্মকাণ্ডও প্রসার লাভ করতে থাকে। এগুলি শহরের ভৌত কাঠামোগত উন্নতি এবং জনসংখ্যা বিস্তারে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখে।’

শরীফ উদ্দিন আহমেদ আরও লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে এবং ঔপনিবেশিক শাসনামলের বেশির ভাগ সময় ধরেই সিলেট শহরটি পাহাড়ি এলাকা, জঙ্গল, সমতল ভূমি ইত্যাদি নিয়ে একটি বিস্তৃত এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছিল। ...শহরের বেশির ভাগ বাড়িই ছিল ছোট ছোট, কাঁচা ঘর এবং বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন মহল্লায় অবস্থিত। ১৮৬৩ সালে সিলেট শহরে প্রায় ৭,২২৮টি বাড়ি ছিল।’

সিলেট শহরের ইতিহাস-ঐতিহ্যসংক্রান্ত নানা বিষয় বিভিন্ন বই-পুস্তকেও পাওয়া যায়। সিলেট অঞ্চলে প্রকাশিত প্রথম ইতিহাসবিষয়ক বই শ্রীহট্ট দর্পণ বা শ্রীহট্টের সংক্ষিপ্ত ভূগোল ও ইতিহাস (১৮৮৬) বইয়ে লেখক মৌলবি মাহাম্মদ আহমদ তৎকালীন সিলেট শহরের একটা ধারণা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সম্প্রতি মিউনিসিপাল কমিসনরগণ সহরকে পূর্ব্বাপেক্ষা অর্দ্ধেক পরিমাণ হইতেও ন্যূন করিয়াছেন। বর্ত্তমান ইহার দক্ষিণে শুরমা নদী, উত্তরে আম্বরখানার সড়ক, পূর্ব্বে গোয়ালিছড়া, পশ্চিমে সাগরদীঘির পার এবং উজার লেন। ...শ্রীহট্ট সহর আকারে বৃহৎ, কিন্তু সকল স্থানে সমান আবাদ নহে।’

১৮৭২ সালের আদমশুমারি অনুসারে সিলেট শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ১২৬। অন্যদিকে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত সৈয়দ মুর্তাজা আলী তাঁর হজরত শাহ্ জালাল ও সিলেটের ইতিহাস বইয়ে জানিয়েছেন, তখন সিলেট শহরের লোকসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ৭৪০ জন।

সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিলেট নগরে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ বাসিন্দা বসবাস করেন। বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। তবে গত বছরের ৩১ আগস্ট সিলেট সদর উপজেলার চারটি ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের কয়েকটি মৌজাকে অন্তর্ভুক্ত করে সিটি করপোরেশনকে প্রায় দ্বিগুণ সম্প্রসারণ করা হয়। এরপর গত ফেব্রুয়ারি মাসে সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকাকে বিন্যস্ত করে নতুন আরও ১২টি সাধারণ ওয়ার্ড গঠন করা হয়েছে। আগের ২৭টি ওয়ার্ডের সঙ্গে মিলিয়ে এখন সাধারণ ওয়ার্ডের সংখ্যা ৩৯। তাই বর্ধিত এলাকাসহ নগরের বাসিন্দা এখন ১৩ থেকে ১৪ লাখ হবে।

সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সিলেট সুপ্রাচীন এক জনপদ। নানা সময়ে নানাভাবে এই শহর বিস্তৃত হয়েছে। এখনো এর ধারাবাহিকতা চলছে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে অনবদ্য দৃষ্টিনন্দন এক শহর হিসেবে সিলেট এখন দেশে-বিদেশে সুপরিচিত। সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতেই আমরা কাজ করে চলেছি।’