ছোটবেলায় আম্বরখানা এলাকায় দিনদুপুরে শিয়ালের ডাক শুনেছি

প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক বিজিতকুমার দে। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর সিলেট শহরের চৌহাট্টা এলাকায় তাঁর জন্ম। কর্মজীবনে ছিলেন একজন শিক্ষক। একজন সমাজ-সংগঠক হিসেবে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বদলে যাওয়া সিলেটকে দেখেছেন খুব ঘনিষ্ঠভাবে। নানা পরিবর্তনেরও সাক্ষী তিনি। প্রথম আলো সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক সুমনকুমার দাশকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি সেই গল্পই শুনিয়েছেন।

বিজিত কুমার দে

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সিলেট শহরেই আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এ শহরের অনেক পরিবর্তন আপনার চোখের সামনে ঘটেছে। শুরুতেই শহরের বদলে যাওয়ার গল্প শুনতে চাই।

বিজিতকুমার দে: আমরা ছিলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক সিলেবাসের শেষ ব্যাচ। এ উপমহাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালে। আমরা ১৯৪৯ সালে ঢাকা বোর্ডের অধীনে স্বাধীনতা–পরবর্তী দ্বিতীয় ব্যাচ হিসেবে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। সিলেট উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত স্কুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল মনোমুগ্ধকর। পড়ার পরিবেশ ছিল চমৎকার। আমরা স্কুলে যেতাম হাফপ্যান্ট পরে, এমনকি খালি পায়ে। জুতা পরার রেওয়াজ ততটা প্রচলন হয়নি। দোয়াত-কালি, এমনকি খাগড়ার কলম আমরা লেখাপড়ার জন্য ব্যবহার করতাম।

তখন সিলেট শহরে দু-একখানা মোটরগাড়ি ছাড়া রিকশার প্রচলনও ছিল সামান্য। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের গণিতের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক চন্দ্রকুমার পাল টিলাগড় থেকে আসতেন মানুষের হাত দিয়ে চালানো টানা রিকশায়। এখানে বলা দরকার, এটা ছিল সিলেটের রাস্তায় প্রথম মানুষের হাতে টানা রিকশা। ইতিপূর্বে কাউকে হাতে টানা রিকশায় চড়তে দেখিনি।

আমাদের ছোটবেলায় শহরের রাস্তা ছিল মাটির। বাড়িঘর ছিল মাটির তৈরি ও টিনের ছাউনিবেষ্টিত। আমাদের বাড়িটিও ছিল মাটির। সবার বাড়িতে ছিল পুকুর ও গাছগাছালি। এখন এসব ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে অট্টালিকা ও দালানকোঠা। লোকসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেন কবির সেই কবিতার মতো—‘ইটের পর ইট, মাঝে মানুষের কীট/ নাহিকো ভালোবাসা, নাহিকো খেলা।’

শহরে মানুষ যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে রিকশা ও যানবাহন বেড়েই চলছে। রাস্তা বড় করতে গিয়ে শহরের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আমরা ছোটবেলায় আম্বরখানা এলাকায় দিনদুপুরে শিয়ালের ডাক শুনেছি। এখন যেখানে সিলেট স্টেডিয়াম, এর কাছেই ছিল সাহেবদের কবরস্থান। মানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের কবর। লোকজনের চলাফেরা এসব স্থানে খুব সীমিত ছিল। অনেকে দিনের বেলা সেসব স্থানে যেতে ভয় পেত। আর পুলিশ লাইনসের ওখানে নেপালি সোলজাররা থাকতেন। তাঁরা দুর্গাপূজা করতেন। ওই যে পুলিশ লাইনসের ভেতরে কালীমন্দির, সেটা তো নেপালিরাই বানিয়েছেন।

এই ছিল মোটামুটি আমাদের বাসা, অর্থাৎ শহরের চৌহাট্টা এলাকার আশপাশের চিত্র। খন চৌহাট্টার যেখানটায় শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল, আমাদের ছোটবেলায় তো আর এটা ছিল না। সেখানে বিশাল মাঠ ছিল। চৌহাট্টা এলাকা ও এর আশপাশে মূলত হিন্দু বসতিই ছিল। ধীরে ধীরে সবকিছু বদলে যায়। সিলেট শহরের নানা পরিবর্তনের সাক্ষী আমি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবনে সিলেট শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিবেশ কেমন দেখেছেন?

বিজিতকুমার দে: তখন শহরে নাটক হতো। বিভিন্ন নাটকে ছেলেরা মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করত। আমিও নাটক করেছি। তখন মেয়েরা খুব একটা নাটকে আসত না। ১৯৬১ সালের দিকে যখন আমরা মদনমোহন কলেজে ভর্তি হই, তখনো কলেজে নাটক হয়েছে। সেখানে নিজে অংশ নিয়েছি। হাওয়াপাড়ার শফিক ছিল আমাদের সহপাঠী, সে-ই এসব নাটক পরিচালনা করত। এসব নাটক কার লেখা, মনে নেই আর। এ ছাড়া রামকৃষ্ণ মিশনেও নাটক করেছি। তখন সারদা স্মৃতিভবনেও নাটক হতো, সেখানেও নাটক দেখেছি।

যখন কলেজে পড়ি, তখন লালকুঠি এবং রংমহল সিনেমা হলে ছবি (চলচ্চিত্র) দেখতে যেতাম। ভারতীয় সিনেমাই বেশিরভাগ দেখানো হতো হলে, সেন্সর হয়ে আসত এসব সিনেমা। আর দেখতাম যাত্রাগান। মালনীছড়া চা-বাগানে যাত্রাগান হতো। বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময়ে বেশি যাত্রাগান হতো। এসব যাত্রাপালার বেশিরভাগই ছিল সামাজিক যাত্রাপালা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সিলেট শহরে আপনাদের তারুণ্য কেমন কেটেছে?

বিজিতকুমার দে: ৪০ কিংবা ৫০ দশক হবে হয়তো, আমাদের চৌহাট্টা এলাকার পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলিত হয়ে ‘মণিমালা সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করি। সমাজসেবার পাশাপাশি সংস্কৃতি, কবিতা ও গানের চর্চা হতো এ সংগঠনের মাধ্যমে। মনরায়ের টিলার নিচে খেলাধুলারও ব্যবস্থা করি আমরা। এ স্মৃতি ভোলার নয়। এ ছাড়া পড়াশোনার অবসরে আমরা কয়েকজন মিলে সমাজসেবামূলক কিছু কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছিলাম। যেমন পাঠাগার স্থাপন, খেলাধুলার ব্যবস্থা, ব্যায়াম চর্চা, দুস্থ ব্যক্তিদের যথাসাধ্য সাহায্য দান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এগুলোর পেছনে প্রথম উদ্যোগী সহপাঠী বন্ধু জিতেন্দ্র কুমার বর্ধনের নাম উল্লেখ করতে হয়। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে অমিয় দাস, বিজয় কৃষ্ণ পাল, দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, নজমুল হোসেন খান ও আমিসহ অনেকের সমবেত প্রচেষ্টায় একটি ক্লাব গঠিত হয়। এর নাম ছিল ‘অ্যাকটিভ ক্লাব’। সেটি স্থাপন করা হয় শহরের মীরাবাজারের উত্তরাংশের ঝেরঝেরিপাড়ায়, স্বর্গীয় আনন্দমোহন দাসের বাসায়, যা বর্তমানে অভিনেতা-সহপাঠী বন্ধুবর খলিল উল্লার পিত্রালয় বলে খ্যাত।

আমরা এলাকায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলাম। পাড়ার মুরব্বিরা আমাদের এ সব কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা ও আন্তরিক সাহায্য-সহযোগিতা এবং উৎসাহদান করতেন। হাওয়াপাড়া এলাকার বাসাগুলোর নম্বরের আগে যে ‘দিশারী’ ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটিও তো আমরাই দিয়েছি।

পঞ্চাশের দিকে বন্ধুবান্ধব মিলে শহরের নানা স্থানে আড্ডা দিয়েছি। তখন তো আর শহরের পরিসর এখনকার মতো বিস্তৃত ছিল না। ১৯৬২ সালের আগে টিলাগড়ের দিকে খুব একটা যাওয়া হতো না। তবে মাঝেমধ্যে দেবপুরে যেতাম। টিলাগড়ের পরের এলাকাই ছিল দেবপুর। এখন ইসলামপুর নামকরণ হয়েছে। সেই দেবপুরে রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমের একটা হাসপাতাল ছিল। সেখানে যেতাম। এখন অবশ্য সেই হাসপাতাল নেই। এখন ওই স্থানে হজরত শাহজালাল (রহ.) উচ্চবিদ্যালয় স্থাপিত আছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা কীভাবে কাটল?

বিজিতকুমার দে: আমি তখন মদনমোহন কলেজের শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিচিতজনেরা বিশেষত মুসলিম শুভানুধ্যায়ীরা বাড়ি ছেড়ে নিরাপদে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁদের পরামর্শে কিছুদিন তাজপুর গিয়ে থেকেছিলাম। এরপর ভারত চলে গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই দেশে ফিরি। সিলেট শহরে পৌঁছে যখন নিজের বাড়ির সামনে গেলাম, দেখি দুটো লাশ পড়ে আছে। একটি লাশ মাটিতে অর্ধপোঁতা। লাশের দুই হাত বের হয়ে আছে। লাশ হিন্দু না মুসলিম, জানি না। পরে আমরা নিয়ে মানিকপীর কবরস্থানে লাশের কবর দিই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়ি দখল করে ফেলেছিল শহরের ধোপাদীঘিরপাড় এলাকার এক ব্যক্তি। পরে আমরা ফিরে এলে অবশ্য ওই ব্যক্তি দখল ছেড়েছিল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনার বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।

বিজিতকুমার দে: ছদরুউদ্দিন আহমদ চৌধুরী আমার বন্ধু ছিল। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। সে যখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হলো, তখন আমিও তার অনুরোধে সেখানে যেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজের স্বার্থে তার সঙ্গে ঘাসও কেটেছি। আমাকে নানা ধরনের কাগজপত্রও সে তখন দেখাত। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার সময়ের নানা ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। এরপর ছদরুদ্দিন যখন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হলো, তখন তার অনুরোধে আমিও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। যদিও পরে প্রবাসজীবনে চলে যাওয়ায় শিক্ষকতাজীবনের ইতি টানতে হয়েছিল।

আমাদের বাসার পাশেই ছিল কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে বই পড়তে যেতাম প্রায়ই। সংসদের প্রাণভোমরা মুহাম্মদ নুরুল হক ছিলেন খুবই ভালো ও অমায়িক মানুষ। আমাদের স্কুলজীবনের আরেক ঘনিষ্ঠ সহপাঠী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এখন সে দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও বিদগ্ধ লেখক। দেশ-বিদেশে তার সুনাম। ভাষা আন্দোলনের সময় শহরে মিছিল-মিটিং আর গোপন বৈঠক হতো। মুহিত ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। আমরা তাকে সাপোর্ট করতাম। কিন্তু আমি নিজে ওইভাবে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হইনি, তবে সেখানে মাঝেমধ্যে যেতাম।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

বিজিতকুমার দে: আপনাকেও ধন্যবাদ।