‘জানের চিন্তা কিছুটা হয়, তবে এখন আর মালের চিন্তা হয় না’

একপাশে পশুর, অন্য পাশে ঢাংমারী নদী আর সুন্দরবন। দুই নদীর মাঝখানের গ্রাম রেখামারী-পূর্ব ঢাংমারী। ওই গ্রামে প্রায় হাজারখানেক মানুষের বাস। জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে সেখানকার অনেক ঘর। যোগাযোগের রাস্তা হয়েছে বিচ্ছিন্ন। বুধবার দুপুরেউত্তম মণ্ডল

বুধবার ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা তিনটার কাছাকাছি। আকাশে জমাট কালো মেঘ আর ঝুম বৃষ্টির মধ্যে দমকা হাওয়ায় গাছগুলো নুয়ে পড়েছে। প্রমত্তা পশুর নদে সবে ভাটার টান শুরু হয়েছে। পাড় থেকে আস্তে আস্তে পানি নামার সঙ্গে ঢেউগুলো আরও জোরালোভাবে আছড়ে পড়ছে পাড়েই। সরু পায়ে চলার রাস্তাটা ভেঙে আরও সরু হচ্ছে। রাস্তার পাশের ছোট্ট ঘরের মধ্যে প্রায় বিছানাসমান জোয়ারের লোনাপানি নামার অপেক্ষায় আবদুল খালেক। খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপের সুন্দরবনসংলগ্ন পূর্ব ঢাংমারী গ্রামে খালেকের বসতি।

খালেক বলেন, ‘আমাগো দেখার কেউ নি। মূল বাঁধের বাইরি পইড়ে আছি। জোয়ারে পানি খুব বেশি হচ্ছে। সঙ্গে ভীষণ বাতাস আর তুফান। রাতে চোখে চোখ দিইনি। আর দুপুরে জোয়ারে ঘরে অনেক পানি উঠে গেছে। রাতের জোয়ারে কী হবে, জানি না। চিন্তার শ্যাষ নি।’

গ্রামের আবদুর সেলিমের কথায়, ‘পানিতে ডুবি আর ভাসি, এটাই তো আমাদের জীবন। জল আর জঙ্গলের পর আমাদের পেট চলে। এখানকার মাটিও ভালো না, এমনিই ধসে পড়ে। আর ঝড়–তুফান হলে কিছু তো বলার থাকে না। সরকার আমাদের নাকি কিছু খাসজমি দেবে। এ রকম আলোচনা মাঝেমধ্যে শুনি। জানি না, কোনো দিন আমাদের নিরাপদ একটা ঘর হবে কি না।’

চুলা পানিতে ডুবে আছে। গত দুই দিন রান্না হয় না। অন্য বাড়ি থেকে যা দিচ্ছে, তাই খেতে হচ্ছে। কিন্তু সকলেই তো অভাবী মানুষ।
একরাম শেখ, রেখামারী-পূর্ব ঢাংমারী গ্রামের বাসিন্দা

একপাশে পশুর নদ, অন্য পাশে ঢাংমারী নদী আর সুন্দরবন। দুই নদীর মাঝখানের গ্রাম রেখামারী-পূর্ব ঢাংমারী। ওই গ্রামে হাজারখানেক মানুষের বাস। ভূমিহীন এসব পরিবারের জীবিকা চলে নদী থেকে বাগদা ও গলদার রেণু পোনা সংগ্রহ করে এবং মাছ ধরে। সুযোগ মিললে সুন্দরবনে কাঠ, গোলপাতা ও মধু সংগ্রহ করে তাদের অনেকেই। বড় আকারের জোয়ার ও সামান্য ঝড় হলে নির্ঘুম রাত কাটে সেখানকার মানুষগুলোর। প্রায়ই জোয়ারের পানি উঠে যায় চলাচলের রাস্তায়। আশপাশে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও নেই যে বিপদে সেখানে আশ্রয় মিলবে। আর বড় ঝড়ের নাম শুনলেই প্রাণ আঁতকে ওঠে তাঁদের।

পাউবো বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন বেঁড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। তবে তীর সংরক্ষণ না করায় ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ে নতুন সেই বাঁধে ভাঙন ধরেছে। এলাকাবাসীর দাবি তীরে পাথরের ব্লক না ফেললে বড় ঝড়ে এই বাঁধ টিকবে না। বুধবার দুপুরে বানীশান্তা বাজার এলাকায়
উত্তম মণ্ডল

গ্রামের বাসিন্দা রিনা বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন, প্রতি রাত অজানা আতঙ্কে পার করি। তবু ইখানেই পড়ে থাকি। আর যাব কোথায়! নদীতে জোয়ারের পানি বাড়ছেই। ভাটা হয় ছয় ঘণ্টা, পুবের বাতাস বেশি থাকায় ভাটা হচ্চে মাত্র তিন ঘণ্টা। এতে পানির চাপ খুব একটা কমছে না। এক একটা জোয়ার যাচ্ছে, রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। কী করার, কপালে যা আছে, তা হবে।’ ওই গ্রামের এবাদুল গাজী বলেন, রাতের চেয়ে দিনে জোয়ার আরও বেড়েছে। রাতে আরও বাড়তে পারে। তবে বাড়ুক না বাড়ুক, দিনে যেমন হয়েছে, এই পরিমাণ জোয়ার হলেও পোষা গরু-ছাগল, বাচ্চাদের নিয়ে ভোগান্তির শেষ থাকবে না।

গত দুই দিন ওই গ্রামের অনেকের ঘরে চুলা জ্বলেনি। এ রকম একজন একরাম শেখ বলেন, ‘চুলা পানিতে ডুবে আছে। গত দুই দিন রান্না হয় না। অন্য বাড়ি থেকে যা দিচ্ছে, তাই খেতে হচ্ছে। কিন্তু সবাই তো অভাবী মানুষ।’

জীবনের সংকটের পাশাপাশি জীবিকার সংকট নিয়ে গ্রামের বাসিন্দা মো. ফারুক খাঁ, রুহুল আমিন, আকরাম শেখ বলেন, তাঁরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রচণ্ড তুফান হওয়ায় চার দিন ধরে নদীতে মাছ ধরতে নামতে পারছেন না। ভীষণ কষ্টে জীবন পার করতে হচ্ছে।

একপাশে পশুর, অন্য পাশে ঢাংমারী নদী আর সুন্দরবন। দুই নদীর মাঝখানের গ্রাম রেখামারী-পূর্ব ঢাংমারী। জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে ওই গ্রামের অনেক ঘর। যোগাযোগের রাস্তা হয়েছে বিচ্ছিন্ন। বুধবার দুপুরে
উত্তম মণ্ডল

আজ দুপুরে জোয়ারের বড় বড় ঢেউ তুফান আকারে আছড়ে পড়ছিল ওই পাড়ায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া রাস্তায়। জোয়ারের সময় বাতাসের বেগে সেখানে দাঁড়ানোই যাচ্ছিল না। মূল রাস্তায় ওঠার জন্য যে সরু পথ ছিল, সেটা ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গ্রামের বাসিন্দা খোকন মণ্ডল সকালে তিনটি গরু অন্য গ্রামে এক আত্মীয়ের কাছে রেখে এসেছেন। তবে ফেরার পথে দেখেন, যাতায়াতের রাস্তাটি আর অক্ষত নেই। ফলে ভাটা হওয়ার অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় একটা দোকানে বসে চিন্তামগ্ন দেখা যায় তাঁকে। খোকন মণ্ডল বলেন, আগে অনেক চওড়া ছিল গ্রাম। এখন দুই নদীর ভাঙনে ৩০০ ফিটের মতো চওড়া আছে গ্রামটি। আর এই রাস্তা আম্পানে ভেঙেছিল, বছরখানেক পর কিছুটা ঠিক হয়েছিল। আবার ভেঙে গেল। আবার বড় ভোগান্তিতে পড়তে হবে। এখন গ্রামের মানুষকে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে বড় রাস্তায় আসতে হবে।

সারা রাত না ঘুমিয়ে পার করা গ্রামের ফাতেমা বেগম বলেন, ‘সারা রাত একফোঁটাও ঘুম হয়নি। ঘরের ভেতরে বসে ছিলাম। ঘর কখন জানি ভেঙে যায়, এই চিন্তা ছিল। রাতে আবারও বড় জোয়ার হবে, তখন কী হবে, তা বলতে পারি না। দূরে একটা সাইক্লোন শেল্টার আছে। তবে আমরা যাওয়ার আগেই আশপাশের মানুষের ভিড়ে তা ভরে যায়। আমাদের জায়গা হয় না। সে জন্য এখন আর যাই না।’

তবে অনেক আতঙ্ক আর হতাশার মধ্যেও যেন কিছুটা নির্বিকার মানুষগুলো। ঝড়ে কত কম ক্ষতি হচ্ছে, সেই নিয়ে অনেকের তুষ্টি ঝরে পড়ছে আলোচনায়। হান্নান মোড়ল অনেকটা হাসিমুখে বলছিলেন, ‘জোয়ারে আমার ঘরের পাটাতন চলে গেছে। এতে বরং ভালো হয়েছে, না হলে ঘরটাই নিয়ে চলে যেত। সঙ্গে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসও ভেসে গেছে। আর বড় ঝড়ে এসব রাস্তাঘাট থাকবে না, তা তো জানা কথাই। জানের চিন্তা কিছুটা হয়, তবে এখন আর মালের চিন্তা হয় না।’