জাফলংয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হত্যার তদন্ত ঠেকাতে তৎপর পাথরখেকো চক্র

জাফলংয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হত্যা মামলার তদন্ত ঠেকাতে পুলিশের বিরুদ্ধে পাথরখেকো চক্রের তৎপরতা বন্ধে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি মদরিছ আলী। বৃহস্পতিবার সিলেটের গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবে
ছবি: প্রথম আলো

সিলেটের জাফলংয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ঠেকাতে গিয়ে সন্ত্রাসী হামলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের নেতা শফিকুর রহমান নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলায় পুলিশের তদন্তের বিরুদ্ধে পাথরখেকো চক্রের অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই হত্যা মামলার প্রধান আসামির বাবা সম্প্রতি আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগে যাঁদের সাক্ষী রাখা হয়েছে, তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, হত্যা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতেই পাথরখেকো চক্র এই অভিযোগ করেছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেটের গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জাফলংয়ে রাতের বেলা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ঠেকাতে গিয়ে গত ১৯ জানুয়ারি নিখোঁজ হন শফিকুর রহমান (৩২)। এক দিন পর ২০ জানুয়ারি ডাউকী নদী থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গোয়াইনঘাট থানায় নিহত শফিকুরের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম আলী বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন।
নিহত শফিকুর গোয়াইনঘাটের লাবু উত্তরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

মামলাটি তদন্ত করছিলেন গোয়াইনঘাট থানার উপপরিদর্শক আবদুল মান্নান। ঘটনার প্রায় তিন সপ্তাহ পর ১৪ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আহাদের বিরুদ্ধে শফিকুর হত্যা মামলার প্রধান আসামি আলীম উদ্দিনের বাবা ইনছান আলী দুর্নীতির অভিযোগে আদালতে একটি অভিযোগ দেন। আদালত অভিযোগটি তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনে তদন্তের জন্য পাঠিয়েছেন।

আদালতে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি মদরিছ আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল ও ফয়জুল ইসলামকে। তাঁরা তিনজন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে লিখিত বক্তব্যে বলেন, তাঁদের না জানিয়েই সাক্ষী রাখা হয়েছে।

শফিকুর হত্যা মামলার প্রধান আসামি আলিম উদ্দিনকে ‘জাফলংয়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, হত্যা মামলা ছাড়াও আলিমের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনসহ মোট নয়টি মামলা আছে। এসব মামলায় আলিম পলাতক আছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশও বিভিন্ন স্থানে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়িয়ে পুরো ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই আলিম তাঁর বাবা ইনছান আলীকে দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আদালতে অভিযোগ করিয়েছেন।

জাফলং সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্যতম প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের জাফলংয়ের পিয়াইন নদ অববাহিকা এলাকায় পাথর কোয়ারি হওয়ায় যত্রতত্রভাবে যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলনে সেখানকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জাফলংকে ইসিএ এরিয়া (পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা) ঘোষণা করা হয়। এরপর পাথর কোয়ারি বন্ধ রেখে জাফলংকে ঘিরে ‘প্রকৃতিকন্যা সিলেট’ নামে পর্যটন ব্রান্ডিং করেছে প্রশাসন। এর মধ্যে জাফলংয়ের ইসিএ এলাকা সুরক্ষায় উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের বিশেষ নজরদারি রয়েছে।

ইসিএ ঘোষিত জাফলংয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে গত প্রায় চার বছরে আলিম উদ্দিনের ছত্রচ্ছায়ায় একটি পাথরখেকো চক্র ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। সংবাদ সম্মেলন থেকে আলিমের অবৈধভাবে উপার্জনের বিষয়টি তদন্ত করা এবং পাথর লুটপাটে জাফলংয়ে শ্রমিক নিহতের ঘটনারও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়। পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকে পাথরখেকো চক্রের বিরুদ্ধে আরও জোরালো ভূমিকা রাখারও আহ্বান জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে জানতে শফিকুর হত্যা মামলার প্রধান আসামি আলিম উদ্দিনের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ধরেননি। তাঁর বাবা ইনছান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ‘আমার কোনো কথা নাই’ বলে ফোন কেটে দেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতে করা অভিযোগে বলা হয়, গোয়াইনঘাট থানার ওসি-এসআইসহ জাফলংয়ে পাথরশ্রমিক সংগঠনের সাতজন ব্যক্তি পাথর উত্তোলনের সুযোগ করে দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।

এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শফিকুর হত্যা মামলার পর থেকে আলিম পলাতক আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সর্বশেষ এই হত্যা মামলা ছাড়াও আরও আটটি মামলা আছে। এসব মামলার কারণে তাঁর পরিবার ও অনুসারী অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের একটি পক্ষ পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। আদালতে আলিমের বাবা যে অভিযোগ করেছেন, সেটি শফিকুর হত্যা মামলাসহ অন্যান্য মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই করা হয়েছে।

জাফলংয়ে পাথর উত্তোলনের সুযোগ করে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে ওসি আরও বলেন, পাথর কোয়ারির কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো। স্থানীয় প্রশাসন দেখভাল করে। পুলিশ প্রশাসনের পদক্ষেপ বাস্তবায়নে আইনি সহায়তা দেয়। এখানে এককভাবে পুলিশের কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। জাফলংয়ের পরিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পাথর কোয়ারি বন্ধ রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করলে পাথরখেকোদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে। এসব কারণে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগ করা হচ্ছে। তবে এসব সত্ত্বেও পুলিশ আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে অবিচল থাকবে।