জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপযাত্রা, দালালচক্র ধরাছোঁয়ার বাইরে

লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি নৌকা ভূমধ্যসাগরে ডুবে নিখোঁজ হন সেন্টু মণ্ডল। স্বামী সেন্টুর ফিরে আসার অপেক্ষায় স্ত্রী ও তিন মেয়ে। শুক্রবার দুপুরে মাদারীপুর সদর উপজেলার নয়াচর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

গত রোববার রাতে দালালের ফোন থেকে কল করেছিলেন সেন্টু মণ্ডল (৪০)। সেন্টু তাঁর স্ত্রী সাথি আক্তারকে ওই সময় বলছিলেন, ‘ভোররাত ৪টায় আমাগো “গেম”(যাত্রা) হবে। আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া কইরো।’ এরপর থেকে সেন্টুর সঙ্গে তাঁর পরিবারের আর কোনো যোগাযোগ নেই।

নিখোঁজ সেন্টু মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের নয়াচর এলাকার আতিয়ার মণ্ডলের ছেলে। ১ মে তিনি দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যান। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সূত্র জানায়, গত সোমবার লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি নৌকা ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর সাগর থেকে ৩৩ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার নৌবাহিনী। ওই নৌকার ৫০ জনের বেশি এখনো নিখোঁজ। উদ্ধার হওয়া ৩৩ জনের সবাই বাংলাদেশি। আবার ৩৩ জনের মধ্যে ২৩ জন মাদারীপুরের বাসিন্দা। এই ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জনের বাড়ি সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের নয়াচর এলাকায়।

এই নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সেন্টুও ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আজ শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে সেন্টুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির চারপাশে মানুষের ভিড়। সেন্টুর শ্বশুর-শাশুড়ি কাঁদছেন। স্ত্রী সাথি আক্তার এখনো তাঁর স্বামী ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। সেন্টুর তিন অবুঝ মেয়ের চোখেও জল। বাবা আর ফিরবে, কি না জানে না তারা। প্রতিবেশীদের চোখও অশ্রুসিক্ত।

আরও পড়ুন

সেন্টুর স্ত্রী সাথি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তিন মাইয়া। ছোট্ট মাইয়াডা ওর বাবার কথা বলে খালি কান্না করে। আমার স্বামী দেশেই ভালো ছিল। এই পথে বিদেশ যাওনের পর থেকে আমাগো চোহে ঘুম নাই। যাওয়ার পরে কয়েকবার ফোনে কথা হইছিল। শেষ রোববার রাতে আমাগো কাছে ফোন দিয়া দোয়া চাইল। তার মাইয়াগো লগে কথা কইল। এরপর থেকে আমার স্বামীর আর কোনো খবর নাই।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নয়াচর গ্রামের মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য মহসিন মাতুব্বর অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি নেওয়ার কথা বলে প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা করে নেন। জমিজমা বিক্রি কিংবা ব্যাংকঋণ এনে প্রত্যেকে মহসিনের হাতে তুলে দেন টাকা। পরে ধাপে ধাপে ১৫ জন তরুণ ও যুবককে লিবিয়ায় নেন মহসিন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই মহসিন নয়াচর এলাকার নজরুল মাতুব্বরের ছেলে। মহসিন দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়াতে থাকেন। গ্রামে থাকা তাঁর চাচাতো ভাইদের মাধ্যমে মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদের ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখান মহসিন। প্রথমে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পৌঁছানোর কথা বলে হাতিয়ে নেন সাড়ে ৪ লাখ টাকা। পরে লিবিয়া থেকে ইউরোপের দেশ ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে আরও নেন ৩ লাখ টাকা। এভাবেই জনপ্রতি সাড়ে ৭ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে মানব পাচারে জড়িত চক্রটি।

ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ১০ তরুণ। তাঁরা সবাই মাদারীপুর সদর উপজেলার নয়াচর এলাকার বাসিন্দা
ছবি: সংগৃহীত

মহসিনের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর চাচাতো বোন সীমা বেগম বলেন, ‘মহসিন ভাইয়ের পরিবার ঢাকায় থাকে। গ্রামের বাড়িতে তাঁরা কম আসেন। এই এলাকায় যাঁরা মহসিন ভাইরে টাকা দিছেন, তাঁরা নিজেরাই যেচে এসে এসে টাকা দিছেন। কেউ তো জোর করে টাকা নেন নাই। এলাকার লোক তাঁরে ধরছেন, তাই তিনি খরচের টাকা লইয়া ইতালি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। এখানে তাঁর তো কোনো ভুল নাই।’

তিউনিসিয়ার নৌবাহিনীর হাতে নয়াচর এলাকার ১৪ জন উদ্ধারের খবরে পরিবারগুলোর মধ্যে স্বস্তি ফিরলেও কাটেনি ভয় আর আতঙ্ক। উদ্ধার হওয়া ২৩ বছর বয়সী তরুণ ইমরান মাতুব্বরের বড় ভাই সরোয়ার মাতুব্বার শুক্রবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই এলাকায় কামকাইজ পাইতাছিল না। তাই ওরে জমিজমা বেইচা সাড়ে ৭ লাখ টাকা খরচ কইরা বিদেশ পাঠাই। আমরা এই এলাকার সবাই মহসিনকে ধরে টাকা দিছি। কারণ, মহসিন আগেও এলাকা থেকে এভাবে লোক নিছে। তারা ইতালি পৌঁছাইয়া এখন খুব ভালো আছে। কিন্তু আমার ভাইডা এখন তিউনিসিয়া আছে। ওরে ইতালি না ঢুকাতে পারলে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাব। দালালও আর টাকা ফেরত দেবে না।’

ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে মামলা বা অভিযোগ দিতে চান না। এখানে সচেতনতা বা প্রচারণা করেও লাভ হচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে ইতালি যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যাঁরা ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা বেশির ভাগ ইতালি পৌঁছে ভালো আছেন। দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এটা দেখে অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছেন। তাই অবৈধ পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফেরানো যাচ্ছে না।
গোলাম মোস্তফা রাসেল, মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি)

এ সম্পর্কে মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি খান মো. শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ পথে বিদেশযাত্রার প্রবণতা মাদারীপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি এলাকায় প্রবাসী আছেন। বর্তমানে তরুণেরা ইউরোপের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। ইউরোপে কাজের জন্য বৈধ পথ না থাকায় তাঁরা দালালের মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একাধিক দালালচক্র। একাধিক মামলা হলেও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা এই দালালচক্র বারবার রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিষয়টি বন্ধ করতে প্রশাসনের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

জানতে চাইলে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। উদ্ধার হওয়া ৩৩ জনের মধ্যে মাদারীপুরের বাসিন্দাই বেশি। তবে ওই নৌকায় বাংলাদেশি বা মাদারীপুরের নিখোঁজ কতজন আছেন, তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। উদ্ধার হওয়া যুবকেরা যাঁদের মাধ্যমে এই পথে গেছেন, সেই দালালদের আমরা চিহ্নিত করেছি। আমরা ৫ জন দালালের নাম–পরিচয় পেয়েছি। এর মধ্যে ২ জন লিবিয়াতে থাকেন। অন্যরা মাদারীপুরের। নৌকাডুবির পর থেকে তাঁরা পলাতক। তাঁদেরকে আমরা খুব দ্রুতই ধরে ফেলব।’

মানব পাচার বন্ধে পুলিশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, প্রশ্নে এসপি আরও বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে মামলা বা অভিযোগ দিতে চান না। আবার যাঁরা যাচ্ছেন, জেনেবুঝেই এই অবৈধ পথে যাচ্ছেন। দালালেরা তাঁদের সঙ্গে কোনো প্রতারণা করে নিয়ে যাচ্ছেন না। অভিবাসনপ্রত্যাশীরা জানেন, প্রথমে তাঁরা লিবিয়ায় যাবেন। পরে সেখানে থেকে সাগরপথে নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে ইতালি যাবেন। এখানে সচেতনতা বা প্রচারণা করেও লাভ হচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে ইতালি যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যাঁরা ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা বেশির ভাগ ইতালি পৌঁছে ভালো আছেন। দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এটা দেখে অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছেন। তাই অবৈধ পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফেরানো যাচ্ছে না।’