‘জেবন বাঁচাটায় আগোত, পরে মাছ ধরা’

মাছ সংকটে ব্যবসায়ী নিখিল চন্দ্রের দোকানে তেমন মাছ নেই। আজ শনিবার রংপুরের পীরগঞ্জের লালদিঘী মাছ বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

আজ শনিবার ভোরের আলো ফুটতেই সোডাপীর বাজারে মাছ কিনতে এসেছিলেন রংপুরের পীরগঞ্জের নখাড়পাড়া গ্রামের আজমত আলী (৪৫)। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দাঁত মাজছিলেন আর বলছিলেন, ‘কয় দিন থাকি হাটোত আসি ফেরত যাওচি; মাছ পাওয়া যাওছে না। মাঝিপাড়া এলাকার মাছুয়ারা (জেলেরা) কেউ আর মাছ নিয়া বাজারোত আইসোছে না।’

আজমত আলীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উপজেলার হাতীবান্ধা গ্রামের আকরাম আলী বলেন, ‘গন্ডগোলের ঘটনার দিন থাকিতো মাঝিপাড়ার জেলেরা মাছ ধরোছে না। ওমরা ঘর থাকি বেরাওচে না। ওই জন্যে হাটোত মাছ নাই, লোকও কম। জেলেরা মাছ নিয়া আইলে এতক্ষণ বাজার জমি (জমে) উঠিল হয়।’

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ১৭ অক্টোবর উত্তেজিত জনতার দেওয়া আগুনে রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া বড়করিমপুর এলাকার জেলেদের ২১টি ঘর ও মাছ ধরার সরঞ্জামাদি পুড়ে যায়। এ সময় নগদ টাকা, গয়নাসহ বাড়ির মালামাল লুট হয়েছে। সেদিন থেকে তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় এলাকায় রয়েছেন। মাছ ধরা তো দূরের কথা; বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঝিপাড়া গ্রামের জেলেদের ধরা মাছে সকাল-বিকেল আশপাশের পীরগঞ্জ হাটবাজার, হাতীবান্ধা বাজার, সোডাপীর বাজার, খেজমতপুর ও বটেরহাট মাছবাজার জমে উঠত। তাঁরা মাছ ধরা বন্ধ রাখায় গত রোববার থেকে এসব বাজারে খাল, বিল ও নদীর মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। চাষের মাছও বাজারে সরবরাহ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, জেলেরা খাল, বিল ও নদীতে মাছ ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন পুকুর ও দিঘিতে পোষা মাছও ধরে দেন। তাঁরা মাছ ধরা বন্ধ রাখায় পাঁচ দিন ধরে বাজারে সব ধরনের মাছের সংকট দেখা দিয়েছে।

অনেকটা পাশাপাশি অবস্থিত ওই হাটবাজারগুলো ঘুরে ব্যবসায়ী ও হাটে আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ছোট আখিড়া নদীর ধারে মাঝিপাড়া গ্রামে জেলেদের বসবাস। আশপাশে রয়েছে ‘বড়বিলা’ নামে একটি বিল। সেখানকার জেলেরা সারা বছর মাছ ধরে আশপাশের হাটবাজারগুলোতে বিক্রি করেন।

পীরগঞ্জ বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মুকুল চন্দ্র বলেন, ২০ বছর ধরে মাছ বেচি। কিন্তু পাঁচ দিন ধরে দেশি প্রজাতির মাছের যে সংকট, তা কখনো হয়নি। মাঝিপাড়ার জেলেরা বাজারে দেশি মাছের প্রধান সরবরাহকারী। তাঁরা ভয়ে বাইরে বের হচ্ছেন না। মাছও ধরছেন না। এ কারণে বাজারে দেশি জাতের মাছ একদম নেই। তাঁরা মাছ ধরা বন্ধ রাখায় চাষের মাছেরও দাম বেড়েছে। ছোট আকারের যে রুই মাছ পাঁচ দিন আগে পাইকারি বিক্রি করেছি ১৫০ টাকা কেজি। সেই মাছ এখন ২৭০-২৮০ টাকা কেজি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। দেশি জাতের মাছ না পেয়ে লোকজন ফিরে যাচ্ছেন। এ কারণে বাজার জমেও উঠছে না।

মাংসের দাম বেশি হওয়ায় খাল, বিলের ছোট মাছ কিনে খেতেন পীরগঞ্জের চতরা গ্রামের রিকশাচালক মিজানুর রহমান। রিকশায় করে যাওয়ার সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্যার, এক কেজি গরুর মাংসের টাকা হইলে এখানে প্রায় তিন কেজি ছোট মাছ পাওয়া যেত। হামরা গরিব মানুষ। মাংসের স্বাদ মাছে মেটাই। ২০০ টাকার মাছ কিনলে ফাটাফাটি; দুই দিন ছইলপইল নিয়া খাইতাম। জেলেদের বাড়িত আগুন দেওয়ার পর থাকি হাটোত মাছ নাই। মাঝেমধ্যে যা আসে, দাম বেশি।’

মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকার হিন্দুপল্লিতে কথা হয় জেলে হরিদাস চন্দ্রের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জাল তো পুড়ি দেছে। মাছ ধরব কী দিয়া! হামরা মাছ না ধরলে হাটোত মাছ থাকে কেমন করি। যেভাবে হামার বাড়ি পুড়ি দেছে, মারছে, লুটপাট করছে—এই অবস্থায় হামরা তো ভয়ে কোথাও যাচ্ছি না। জেবন বাঁচাটায় আগোত, পরে মাছ ধরা।’

পীরগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম আজ মুঠোফোনে বলেন, মাঝিপাড়ায় জেলের সংখ্যা শতাধিক। তাঁরা প্রতিদিন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামে সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাঁরা মাছ ধরতে বের হচ্ছেন না। অনেকের জাল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে কিছুটা মাছের সংকট রয়েছে। তবে কিছুটা ক্ষতি পোষাতে ১৫ জন জেলেকে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ১৫টি পাক জাল দেওয়া হয়েছে।