জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ চার কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পেল তদন্ত কমিটি

চুয়াডাঙ্গা খাদ্যগুদামে মজুত দুর্গন্ধযুক্ত চাল। ১৯ জুলাই তোলা ছবি
প্রথম আলো

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে ভিজিএফের নিম্নমানের চাল বিতরণে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. রেজাউল ইসলামসহ চার কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মনিরা পারভীনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি সম্প্রতি জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকারের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

অভিযুক্ত বাকি তিন কর্মকর্তা হলেন সদর উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-এলএসডি) মো. আবু বকর ছিদ্দিক , জীবননগর উপজেলা খাদ্যগুদামের ওসি-এলএসডি মো. কাওসার আহমেদ ও সদর উপজেলা কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক মো. আনিছুর রহমান।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নে ঈদুল আজহা উপলক্ষে গত ১৮ জুলাই ভিজিএফ কার্ডধারী ৬০০ জনকে খাওয়ার অযোগ্য দুর্গন্ধযুক্ত ও পচা চাল দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. রেজাউল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ১০ হাজার ৫৬০ কেজি নিম্নমানের চাল জব্দ করেন। জব্দকৃত চাল সদর খাদ্যগুদামে আনা হয় এবং সেখান থেকে সমপরিমাণ ভালো চাল বেগমপুরে নেওয়া হয়।

পরদিন উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে দিনব্যাপী ১ হাজার ৫৬০ জনের মধ্যে ভালো চাল বিতরণ করা হয়। এ নিয়ে গত ১৯ জুলাই প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ‘ভিজিএফ কার্ডধারীদের দেওয়া হলো দুর্গন্ধযুক্ত চাল’ এবং ২০ জুলাই ছাপা সংস্করণে ‘কার্ডধারীদের দেওয়া হলো দুর্গন্ধযুক্ত চাল’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।

এ ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার ঈদের ছুটি শেষে ২৬ জুলাই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মনিরা পারভীনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. আবু তারেক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা (ডিটিও) সুফি মো. রফিকুজ্জামান, জেলা বাজার তদারকি কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. রেজাউল ইসলাম। কমিটির সদস্যরা ২৭ জুলাই সরেজমিন তদন্ত করেন এবং ঘটনার অনুসন্ধানে পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

ভিজিএফের দুর্গন্ধযুক্ত চাল সরবরাহের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সদস্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. রেজাউল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা চলে আসায় কমিটির সদস্যরা বিব্রত হন। এরপর তাঁকে ছাড়াই তদন্ত কমিটির অপর সদস্যরা তদন্তের কাজ এগিয়ে নেন।

জানা গেছে, ভিজিএফের দুর্গন্ধযুক্ত চাল সরবরাহের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সদস্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. রেজাউল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা চলে আসায় কমিটির সদস্যরা বিব্রত হন। এরপর তাঁকে ছাড়াই তদন্ত কমিটির অপর সদস্যরা তদন্তের কাজ এগিয়ে নেন এবং তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেন।

তদন্ত কমিটির মুখোমুখি
তদন্তের সময় বাইরে রাখা হলেও অভিযোগের বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বক্তব্য নেওয়া এবং তা তদন্ত প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ১৩ জনের বক্তব্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি। তাঁরা হলেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. খায়রুল আনাম, পরিবহন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এমএন এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি মো. হাসানুর ইসলাম, বেগমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলি হোসেন জোয়ার্দার, প্যানেল চেয়ারম্যান মো. জিললুর রহমান, ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. আমিনুল ইসলাম, সচিব মো. ফয়জুর রহমান, গ্রাম পুলিশ আবদুল আলী, ভিজিএফ কার্ডধারী মো. মহাসীন, মো. নাসির উদ্দিন ও মো. আবদুল খালেক এবং সদর উপজেলা খাদ্যগুদামের ওসি–এলএসডি মো. আবু বকর ছিদ্দিক, জীবননগর উপজেলা খাদ্যগুদামের ওসি-এলএসডি মো. কাওসার আহমেদ ও সদর উপজেলা কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক মো. আনিছুর রহমান।

নিম্নমানের চাল জানা সত্ত্বেও সংগ্রহ ও বিতরণ করেন তাঁরা
জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়েছে, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, দুজন ওসি-এলএসডি ও কারিগরি পরিদর্শক নিম্নমানের চালের বিষয়টি সংগ্রহ থেকে বিতরণ পর্যন্ত জানতেন। বেগমপুর ইউনিয়নে ভিজিএফ কর্মসূচিতে বিতরণকৃত চাল জীবননগর খাদ্যগুদাম থেকে পাঠানো। জীবননগর উপজেলা খাদ্যগুদামের ওসি-এলএসডি মো. কাওসার আহমেদ অসৎ উদ্দেশ্যে যোগসাজশ করে স্থানীয় সাথী রাইস মিল, দেশবাংলা ও এঅ্যান্ডজেএম অটোরাইস মিল থেকে সংগ্রহ করেন।

চুয়াডাঙ্গা খাদ্যগুদামে মজুত দুর্গন্ধযুক্ত চালের বস্তা। ১৯ জুলাই তোলা ছবি
প্রথম আলো

গত ৫ জুলাই ৫০০ মেট্রিক টন চাল জীবননগর থেকে সদর এলএসডিতে পাঠানো হয়। ২০ মেট্রিক টন করে ২৫টি ট্রাকে পাঠানো হয়। প্রতিটি ট্রাকের নমুনা পরীক্ষার কথা থাকলেও কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক তা করেননি। চালগুলো নিম্নমানের ও লাল রঙের জানানোর পরও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তা গুদামে রাখতে সদর ওসি–এলএসডিকে নির্দেশ দেন। জীবননগর থেকে পাঠানো চাল বিতরণের কথা না থাকলেও সদর ওসি–এলএসডি তা সরবরাহ করেছেন।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জীবননগর ওসি-এলএসডি, সদর ওসি-এলএসডি ও কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক—সবাই চাল নিম্নমানের জানা সত্ত্বেও জীবননগর ও সদর খাদ্যগুদামে গুদামজাত এবং বেগমপুর ইউনিয়নে ভিজিএফ কর্মসূচিতে চালগুলো সরবরাহ করেছেন।

কমিটির মতামত
চুয়াডাঙ্গা সদর খাদ্যগুদাম পরিদর্শনকালে তদন্ত কমিটির কাছে ওই চাল নিম্নমানের মনে হয়। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জীবননগর ওসি-এলএসডি, সদর ওসি-এলএসডি ও কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক—সবাই চাল নিম্নমানের জানা সত্ত্বেও জীবননগর ও সদর খাদ্যগুদামে গুদামজাত এবং বেগমপুর ইউনিয়নে ভিজিএফ কর্মসূচিতে চালগুলো সরবরাহ করেছেন। এটা স্পষ্ট যে জীবননগর ওসি-এলএসডি মো. কাওসার আহমেদ অসৎ উদ্দেশ্যে যোগসাজশে এই নিম্নমানের চাল গুদামে গ্রহণ করেন, যা পরবর্তীকালে বেগমপুর ইউনিয়নে ভিজিএফের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে বিতরণ করা হয়। ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. রেজাউল ইসলাম, সদর উপজেলা খাদ্যগুদামের ওসি-এলএসডি মো. আবু বকর ছিদ্দিক , জীবননগর উপজেলা খাদ্যগুদামের ওসি-এলএসডি মো. কাওসার আহমেদ ও সদর উপজেলা কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক মো. আনিছুর রহমান নিম্নমানের চাল জানা সত্ত্বেও ওই চাল গুদামজাতসহ ভিজিএফ কর্মসূচিতে বিতরণ করে দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন।
জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার প্রথম আলোকে জানান, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়া গেছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনটি শিগগিরই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে।