‘টেনেটুনেও দিন চালানো যাচ্ছে না’

সুনামগঞ্জে শ্রমের হাটে বাড়ছে অভাবী মানুষের ভীড়। কাজের আশায় বসে আছেন লোকজন। ছবিটি পৌর শহরের কালীবাড়ি মোড় থেকে মঙ্গলবার সকালে তোলাছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কালীবাড়ি মোড়ে সকাল হলেই জড়ো হন দুই থেকে আড়াই শ নারী-পুরুষ। কাজের সন্ধানে শহর ও গ্রাম থেকে আসেন তাঁরা। একসময় সংখ্যাটা আরও কম ছিল। দিন দিন এই শ্রমের হাটে বাড়ছে অভাবগ্রস্ত মানুষের ভিড়।

ষাটোর্ধ্ব শুকুর আলী এখানে আসেন ১৫ বছর ধরে। দোয়ারাবাজার উপজেলার সাউদেরগাঁও গ্রামে তাঁর বাড়ি। প্রতিদিন আসা-যাওয়ায় ৪০ টাকা ব্যয় হয়। তবে সব দিন কাজ মেলে না। মঙ্গলবার সকালে এখানে শুকুর আলীর সঙ্গে প্রথম আলোর এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি জানান, স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। তাঁর আয়েই সংসার চলে। তিন দিন ধরে শুধু আসা-যাওয়া করছেন। কোনো কাজ পাননি। কাজ পেলে দিনে রুজি হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে বাজারসদাই নিয়ে বাড়ি যান। ঘরের লোকজন তাঁর অপেক্ষায় থাকেন। যেদিন খালি হাতে ফেরেন, সেদিন বড় কষ্ট হয়।

সকাল সাড়ে ৯টা বাজার পরও কাজ না পাওয়ায় হতাশ শুকুর আলী বলেন, আগের মতো কাজ নেই। লোকজনও বেশি। কেউ একজন শ্রমিক নিতে এলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। আজও মনে হয় খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হবে।

শুক্কুর আলীর পাশে ফুটপাতে বসে আছেন একই গ্রামের ধরণি কান্ত দাস (৫৫)। তিনি ঘরের সংস্কারকাজ করেন। একটি থলের মধ্যে হাতুড়ি, করাতসহ বিভিন্ন সামগ্রী। ধরণি কান্ত দাস বলেন, ‘চাল-ডাল, তেল, লবণসহ সবকিছুর দাম বাড়ছে। এখন পোয়া হিসেবে তেল কিনি। ডাল-ভাত খাওয়াই দায় হয়ে পড়েছে। একদিন কাজ পাইলে, তিন দিন বেকার যায়। টেনেটুনেও সংসার চালানো যাচ্ছে না। সব বিপদ তো গরিব মানুষের।’

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবীনগর এলাকার বাসিন্দা সবুজ মিয়া (৪০) আগে একটি বেকারিতে কাজ করতেন। করোনার সময় বেকারিটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে প্রতিদিন এখানে আসেন কাজের খোঁজে। কোনো দিন কাজ মেলে, আবার কোনো দিন মেলে না। সবুজ বলেন, ‘ঘরে মা অসুস্থ, তাঁর চিকিৎসা, সবার খাওয়াদাওয়া সবই আমার ওপর। একটা মেয়ে স্কুলে পড়ে। তার লেখপাড়ার খরচও জোগাড় করতে হয়। কিন্তু দিন তো খালি কঠিন হচ্ছে। বাঁচার উপায় তো দেখছি না।’

শহরের আরপিননগর এলাকার বাসিন্দা তহুর আলী (৪৮) জানান, এখানে একসময় শহরের শ্রমিকেরা আসতেন বেশি। এখন আসছেন গ্রামের লোকজন। তহুর আলী বলেন, এবার হাওরে বন্যার জন্য ধান নষ্ট হয়ে গেছে। সবাই সমস্যায় আছেন। তাই শহরে কাজের জন্য আসছেন তাঁরা।

সদর উপজেলার শ্রীনাথপুর গ্রাম থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পথ হেঁটে প্রতিদিন সকালে পৌর শহরের কালীবাড়ি মোড়ে শ্রমের হাটে আসেন আফিরুন বেগম (৫০)। অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে এ প্রতিবেদক কথা বলার সময় কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে ভেবে নিজের নামটি লেখানোর জন্য আকুতি-মিনতি শুরু করেন। জানালেন, স্বামী নেই। ১০ বছর আগে মারা গেছেন। এর পর থেকে সংসারের জোয়াল তিনি একাই টানছেন। এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। মেয়েটা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আফিরুন বেগম বলেন, ‘সকালে লবণ দিয়া পানিভাত খাইয়া আইছি। গতকালও কাজ পাইছি না। আজও কাজের আশা দেখছি না। অখন আবার অতটা পথ পায়ে হাঁইটাই যাইত অইব। ঘরও চাল-পাত নাই। বাড়িত গিয়া যে চাইরটা ভাত খাইমু, এই উপায় নাই।’

একইভাবে সংসার চালাতে গিয়ে ‘ভীষণ কষ্ট’ করতে হচ্ছে বলে জানান, সদর উপজেলার নলুয়ারপাড় গ্রামের শ্রমিক আবদুল কাইউম (৪০), শহরের নতুনপাড়া এলাকার বাসিন্দা বিজয় দাস (৬০), হাসননগর এলাকার বাসিন্দা ফাতেহা বেগম (৪৫), ষোলঘর এলাকার কোকিলা দাস (৩৮), সুশীল বর্মণ (৪৬), সৈয়দপুর গ্রামের নেহারুন বেগম (৩৫)। নিজেদের নামটি লেখানোর জন্য আরও অনেকে ঘিরে ধরেন এই প্রতিবেদককে। শ্রমিক আবদুল কাইউম বলেন, ‘আমি এক সপ্তাহ হয় আসি। সামান্য কিছু জমি ছিল। বন্যায় জমির ধান তলিয়েছে। এখন কোনো উপায় নাই, তাই গ্রাম থাকি শহরে আইতে অইছে।’

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমের হাটে আসা লোকজনের মধ্যে হতাশাও বাড়তে থাকে। কাজ না পাওয়ার বিষয়টি ধীরে ধীরে নিশ্চিত হতে থাকে অনেকের। যেখানটায় এসব লোক জড়ো হন, তার পেছনেই একটি বড়সড় ওষুধের দোকান। সকাল সোয়া ১০টার দিকে দোকানের এক কর্মীর মোটরসাইকেল এসে থামে সেখানে। বেসুরে হর্ন বাজাতে থাকেন তিনি। শ্রমিকেরা বুঝে যান, আজকের মতো তাঁদের সময় শেষ। জায়গাটা ছাড়তে হবে। তাই যে যাঁর মতো করে হাঁটতে শুরু করেন বাড়ির পথে।