ডকইয়ার্ডের নারী শ্রমিকদের সংগ্রামের জীবন

ডকইয়ার্ডে কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। খুলনা নগরের ওয়াপদা বেড়িবাঁধের কাস্টম ঘাট এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

জোয়ারের পানিতে একটু একটু করে ফুলতে শুরু করেছে নদী। সাতসকালেই ভৈরব-রূপসার সংযোগস্থল খুলনার জেলখানা ঘাট ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ট্রলারে নদী পার হয়ে দলে দলে মানুষ তখন শহরে ঢুকছে। আবার শহরের আড়ত থেকে ভ্যানভরা সবজি যাচ্ছে ঘাটের ওপারে।

কাজের জন্য শহরে আসা এ রকম একটি দলের সঙ্গে দেখা হয় জিলা স্কুলের সামনের রাস্তায়। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন চার সদস্যের ওই নারী দল। গন্তব্য ওয়াপদা বেড়ি বাঁধের ২ নম্বর কাস্টম ঘাট। সেখানকার একটি ডকইয়ার্ডে কাজ করেন তাঁরা।

বুধবার সকালে কাস্টম ঘাটের দিকে যেতে আরও নারী শ্রমিকের দেখা মিলল। ডকইয়ার্ডে পৌঁছে দেখা গেল, দু-তিনজন করে ছোট দলে ভাগ হয়ে নারীরা গল্প করছেন। তাঁদের গল্পে যোগ দিয়ে জানা গেল, ওই ডকইয়ার্ডে এখন দুটি জাহাজের কাজ চলছে। এর মধ্যে একটি জাহাজে রঙের কাজ কিছুটা বাকি আছে। অন্য জাহাজে মাত্র কাজ শুরু হয়েছে। ৩০ জন নারী সেখানে কাজ করছেন। গল্পের ছলে জানা গেল, নারীদের অনটন আর জীবনসংগ্রামের কথা।

সকাল সাতটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত কাজ হয় ইয়ার্ডে। রমজানের সময় এক ঘণ্টা আগে ছুটি মিলছে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ছোলা, আলু সেদ্ধ আর শীতের সময় চিতই পিঠা বিক্রি করেন সুলতানা। এখন রোজার সময় পেঁয়াজু, আলুর চপসহ ইফতারসামগ্রী বিক্রি করছেন।

সুলাতানা রাজিয়া ছোটবেলা থেকেই বাইরে বাইরে কাজ করছেন। দীর্ঘ সময় তিনি চালকলে কাছ করেছেন। কাজ করেছেন মাছ কোম্পানিতে। আবার ব্যাপারীর কাছ থেকে সুপারি নিয়ে কুচিয়ে দেওয়ার কাজ করেছেন একসময়। প্রায় ১৮ বছর ধরে তিনি এখন ডকইয়ার্ডে কাজ করছেন। সুলতানা বললেন, ‘সুখ নেই কপালে। বয়স ৫০ হয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে খাটছি। খাটতে খাটতে শরীর, জীবন শেষ করে ফেললাম।’

সুলতানার বাড়ি ভৈরব নদের ওপারে পশ্চিম আইচগাতি গ্রামে। পরিবারে ছয়জন সদস্য। দুর্ঘটনায় স্বামীর পা ভেঙে গেছে। ভাঙা পা নিয়ে মাঝেমধ্যে রিকশা চালান। ছোট ছেলেটা এখনো উপার্জনক্ষম হয়নি। আলাদা সংসার পেতেছে বড় ছেলে। বড় ছেলের প্রথম স্ত্রী সুলতানার সংসারেই থাকেন। আবার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে মেয়ের সংসার টেকেনি। এখন প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে মায়ের বাড়িতেই থাকছেন মেয়ে।

সকাল সাতটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত কাজ হয় ইয়ার্ডে। রমজানের সময় এক ঘণ্টা আগে ছুটি মিলছে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ছোলা, আলু সেদ্ধ আর শীতের সময় চিতই পিঠা বিক্রি করেন সুলতানা। এখন রোজার সময় পেঁয়াজু, আলুর চপসহ ইফতারসামগ্রী বিক্রি করছেন।

সুলতানা বলেন, ‘সংসার তো চলে না। ঘরভাড়ার পাশাপাশি সবকিছুই কেনা। স্বামী একদিন বের হলে আরেক দিন বের হতে পারে না। এই জীবনে কোনো দিন স্বস্তি মিলবে কি না জানি না।’

সাতটা বাজার পনেরো মিনিট আগে থেকে কাজের প্রস্ততি নিতে শুরু করলেন নারীরা। এই দলের প্রধান রওশন আরা। তিনিও নদীর ওপারের নৈহাটির রামনগর গ্রামের বাসিন্দা। রওশনের স্বামী ছিলেন এই ডকের সরদার। তিনি মারা যাওয়ার পর ডকের মালিক তাঁকে সরদারের দায়িত্ব দিয়েছেন।

রওশন আরা বলেন, নৌযান ডকে তোলার পর মালিকের সঙ্গে আলাপ করে সরদারকে ডাকা হয়। কীভাবে কাজ হবে—তখন সেটা জানানো হয়। পরে জাহাজের মালিকের চাহিদা অনুপাতে লোক নিয়ে আসেন সরদার। মাসখানেক ধরে এই ডকে ৩০ জন কাজ করছেন। এর আগে দু–তিন মাস কাজ ছিল না। তখন প্রতিদিন তিন-চারজনের কাজ ছিল।এখানে যাঁরা কাজ করেন, সবাই অসহায়। কাজ থাকলে তবু কষ্টে চলে যায়। কিন্তু কাজ না থাকলে খুব সমস্যা। আর বেতন খুবই কম। প্রতিদিন ২৬০ টাকা। তা–ও মালিক দিতে চান না।

কাজ শুরুর আগে খোশগল্পে মেতেছেন নারী শ্রমিকেরা
ছবি: প্রথম আলো

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখানে নারী শ্রমিকেরা হাতুড়ি দিয়ে জাহাজের জং (মরিচা) ঝরান, পরে যন্ত্রের সাহায্যে ঘষেন, সব প্রক্রিয়া শেষে রং করা হয়। এই তিন বিভাগেই নারীরা কাজ করেন। তবে এসব কাজে কম মজুরির পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও আছে।

রূপসার রাজাপুরের শ্রমিক জলি দে (৬০) বলেন, ‘আমাদের কষ্ট তো বলে বোঝানো যাবে না। কাজ সব সময় মেলে না। মাঝে তিন সপ্তাহ বসে ছিলাম। ডকে কাজ করা কঠিন। এখানে এত শব্দ যে একজনের কথা আরেকজন শোনে না। এক ঘণ্টা কাজ করে রাস্তায় গেলে আপনি খানিকক্ষণ কিছু শুনতে পাবেন না। আমাদের প্রায় সবারই কানের সমস্যা, চোখের সমস্যা।’

নারীদের দলের মধ্যে একমাত্র পুরুষ সদস্য মো. কালু সানা (৬২)। স্ত্রীর সঙ্গে সানাও একই মজুরিতে কাজ করেন। সানা বলেন, ‘সংসার কোনোমতে টেনে নিতে হয়। খাওয়াদাওয়াও কম। খাব কোন জায়গা দিয়ে। একটা মুরগি কিনতি গিলিও ৩০০ টাকা লাগে। আমাগে কামাইতে সম্ভব না। যদি কোনো জায়গায় দাওয়াতটাওয়াত থাকে, তাহলে ভাগ্যে একটু ভালোমন্দ জোটে, নাহলে নাই।’

কথায় কথায় প্রায় সাতটা বেজে এল। রেক্সোনা নামের একজন নারী শ্রমিক খাতা দেখে নাম ডাকতে শুরু করলেন—মুরশিদা, এনির মা, আকলি, বাবুর মা...। উপস্থিতির জানান দিয়ে চোখে চশমা পরে হাতুড়ি নিয়ে জাহাজের কাছে এগিয়ে গেলেন মুরশিদা–সুলতানারা। জাহাজের ধাতব শরীরে হাতুড়ির আঘাতের বিরামহীন শব্দের মধ্যে যেন তাঁরা ভুলে থাকতে চাইলেন যাপিত জীবনের কষ্টগুলো।