‘ডাইল আর আলুই ভরসা’

কয়েক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।

‘ইনকাম কম, খরচ বেশি, জিনিসের দামও বাড়ছে। পরিবার চালাইতে হিমশিম খাইতাছি। মাছ-মাংস এখন স্বপ্ন, ডাইল আর আলুই ভরসা। ট্যাকার চিন্তায় ডেইলি চোখে আন্ধাইর দেখি।’ কথাগুলো নগরের শাহি ঈদগাহ এলাকার রিকশাচালক চল্লিশোর্ধ্ব আলাউদ্দিনের। তাঁর মূল বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। পাঁচ বছর ধরে সিলেট শহরে রিকশা চালাচ্ছেন। প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে তাঁর গড় আয় হয় ৪০০ টাকা। তা দিয়েই চলে তাঁর সাত সদস্যের সংসার।

আলাউদ্দিন জানান, অসুস্থ বাবা, স্ত্রী আর চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। প্রতি মাসে গড়ে তিনি ১২ হাজার টাকা আয় করেন। বাবার চিকিৎসা, দুই সন্তানের লেখাপড়া, বাসাভাড়া থেকে শুরু করে পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। একদিকে তাঁর স্বল্প আয়, অন্যদিকে কয়েক মাসের ব্যবধানের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তাই পরিবার চালাতে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নগরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১২ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই দ্রব্যমূল্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে জ্বালানি গ্যাস, সয়াবিন তেল, চাল, ডাল, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সংসারে অভাব লেগেই আছে। তাই সরকার দাম কমানোর ব্যাপারে একটু আন্তরিক হলেই মানুষ স্বস্তি ফিরে পাবে।

স্কুলশিক্ষক সুবিমল রায় বলেন, কয়েক মাস আগে ১২ লিটারের যে গ্যাসের সিলিন্ডার ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকায় কেনা যেত, সেটাই এখন ১ হাজার ২৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। প্রতি মাসে গড়ে দুটি সিলিন্ডারের প্রয়োজন পড়ে। চাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, ডালসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছে। মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত—সবাই সংকটে পড়েছেন। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় লোকজন আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করতে পারছেন না।

একাধিক ক্রেতা ও বিক্রেতা জানিয়েছেন, শীতের মৌসুমেও সবজির দাম চড়া ছিল। বাজারে শীতের সবজি এখনো প্রচুর থাকলেও, দাম কমেনি। খুচরা বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও প্রতি লিটার ২ থেকে ৩ টাকা কম ছিল। বর্তমানে মোটা আকৃতির ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন বিপর্যস্ত।

নগরের দরগাগেট এলাকায় থাকেন সবুজা বেগম (৪২)। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে তাঁর। তিনি অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন এক মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। বড় ছেলে তারেক আহমেদ বলেন, তিনি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঁচ হাজার টাকায় অফিস সহকারীর কাজ করেন। তাঁর মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আড়াই হাজার টাকা আয় করেন। তারেকের ভাষ্য, প্রবাসী এক বাসার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তাঁরা থাকায় বাসা ভাড়া দিতে হয় না। তবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলবাবদ তাঁদের প্রতি মাসে গড়ে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। মা-ছেলের হাতে থাকা বাকি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তাঁদের কোনো রকমে খেয়ে-পরে থাকতে হচ্ছে। একটা মাছ কিনে ছোট ছোট টুকরা করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে অনেক দিন ধরে খান। তিন থেকে চার মাস পরপর মাংস খান।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক দেবাংশু দাস বলেন, জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই চড়া। তাই কোনোভাবেই যেন ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে অন্যায্যভাবে পণ্যের দাম বাড়াতে না পারেন, সেদিকে স্থানীয় প্রশাসনকে কড়া নজরদারি রাখতে হবে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান প্রথম আলোকে, সরকার নির্ধারিত দামের বাইরে যেন কোনো ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্য অন্যায্যভাবে বাড়াতে না পারেন, সে জন্য বাজার তদারকির পাশাপাশি নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এ ছাড়া ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে গরিব ও বিপাকে পড়া মানুষের জন্য কম দামে তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য প্রচুর বিক্রি করা হচ্ছে। রমজান মাস সামনে রেখে এসব পণ্য বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে।

মৌলভীবাজার কমলগঞ্জ

প্রথম আলোর কমলগঞ্জ প্রতিনিধি মুজিবুর রহমান বাজার ঘুরে জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে কমলগঞ্জের বাজারগুলোতে দাম বেড়েছে সয়াবিন তেল, সাবান, লবণ, চাল, গ্যাসের সিলিন্ডার, শাকসবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের। খুচরা বাজারে কেজিতে পাঁচ থেকে আট টাকা করে বেড়েছে এসব পণ্যের দাম। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষদের পণ্য কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

কমলগঞ্জে বাজার ঘুরে দেখা যায়, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। কাঁচকলার হালি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। পেঁপে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। শসা বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়।