ডিঙিনৌকার শতবর্ষী হাট

নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর খালে নৌকার হাট। গত ২৯ আগস্ট বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

খালের পাড়ে সারি সারি ভিঙিনৌকা বাঁধা। বিক্রেতারা খাল বেয়ে নৌকা নিয়ে হাটে আসছেন। আবার বড় নৌকা ও ট্রলারে করেও হাটে নিয়ে আসা হচ্ছে এ নৌকা। ঢেউয়ের তালে তালে চলছে কেনাবেচা। নৌকার হাটের পাশে রয়েছে পেয়ারা, আমড়াসহ কৃষিপণ্যের ভাসমান বাজার। এ দৃশ্য চোখে পড়বে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা খালে।

শত বছর ধরে আটঘর ও কুড়িয়ানা গ্রামের পাশের খালে ভাসমান হাট বসছে। আটঘর খালে বর্ষা মৌসুমে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে নৌকা কেনাবেচা।

উপকূলীয় এলাকাগুলোতে যাতায়াতের বাহন হিসেবে নৌকাই জনপ্রিয়। ঘর থেকে বের হতে এর প্রয়োজন হয়। নৌকায় পণ্যের পসরা সাজিয়ে ভাসমান হাটে বিক্রি করতে যান এখানকার মানুষ। আবার সদাইপাতি কিনে ডিঙিনৌকা বেয়েই ঘরে ফেরেন তাঁরা।

দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার মানুষের নৌকার চাহিদা মেটাতে নেছারাবাদের আটঘরে কৃষিপণ্যের ভাসমান হাট ও নৌকার হাটের গোড়াপত্তন ঘটে।

আটঘর কুড়িয়ানা খালের বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। এ খালের কয়েক কিলোমিটারজুড়ে কৃষিপণ্যের ভাসমান হাট বসলেও নৌকার হাট বসে শুধু আটঘরে।

নেছারাবাদ উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্ব দিকে আটঘর বাজার। বছরের জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র মাস (সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি) পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের নৌকার সবচেয়ে বড় হাট বসে এ বাজারে। অতি সম্প্রতি এক সকালে আটঘরের নৌকার হাটে গেলে দেখা যায়, প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে সড়ক ও খালের দক্ষিণ প্রান্তে শত শত নৌকা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দরদাম করে পছন্দের নৌকা কিনে বাড়ি ফিরছেন। নৌকার পাশাপাশি হাটে বইঠাও বিক্রি হচ্ছে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, নেছারাবাদ উপজেলার ডুবি, কাটাখালী, একতা, চামী গ্রামের কয়েক শ পরিবার নৌকা তৈরি করে। এসব গ্রাম থেকে নৌকা কিনে হাটে নিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। একসময় সুন্দরী কাঠ সহজলভ্য ছিল। তখন এ কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি হতো। এখন সেটি দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় কড়াই, চাম্বুল ও মেহগনি কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হয়। বর্ষা মৌসুমে গ্রামগুলোতে গেলে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগরেরা।

নৌকা ব্যবসায়ী চামী গ্রামের মো. ফারুক জানালেন, হাটে চার ধরনের ডিঙিনৌকা বিক্রি হয়। আকারভেদে একেকটি নৌকার দাম দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। ছোট একটি আটহাতি ডিঙিনৌকা দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আর সবচেয়ে বড় বারোহাতি ডিঙিনৌকা চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তবে নৌকার দাম পুরোটাই নির্ভর করে ক্রেতা–বিক্রেতার দর–কষাকষির ওপর। বেচাকেনা ভালো হলে প্রতি হাটে আট শ থেকে এক হাজার নৌকা বিক্রি হয়। প্রতি নৌকায় ব্যবসায়ীদের লাভ দুই শ থেকে পাঁচ শ টাকা, আবার কখনো লোকসানও গুনতে হয়।

প্রতিবছরের বর্ষা মৌসুমে আটঘর কুড়িয়ানা খালের ভাসমান পেয়ারা ও নৌকার হাট দেখতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পর্যটক আসেন। তাঁরা নৌকা ও ট্রলারে ভ্রমণ করেন।

পিরোজপুরের স্থানীয় লেখক জগৎপ্রিয় দাস বলছিলেন, ভাসমান নৌকার হাট এখানকার সংস্কৃতির অংশ। এই অঞ্চলে একাধিক ভাসমান হাট রয়েছে। স্থানীয় মানুষের কাছে নৌকার চাহিদা অটুট থাকায় একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আটঘর কুড়িয়ানা খালে ডিঙিনৌকার হাটের জৌলুশ কমেনি।